নতুন সরকারের মন্ত্রীরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নিত্যপণ্যের দাম কমানোর। আসলে তা কতটা সম্ভব তা দেখার বিষয়। কারণ ভরা আমন মৌসুমে চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তার কারণ কী? এই কারণটি উদ্ঘাটন করলেই চালের দাম কমানো প্রক্রিয়াটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। ধান থেকে চাল আর এখন প্রান্তিক কৃষকেরা বানায় না, চাল বানায় বড় বড় মিলগুলো। কিছুদিন আগেও যে ছোট ছোট চাতাল চাল বানাতো তারাও চাল বানানো বন্ধ করে দিয়েছে। ছোট ছোট চাতাল প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বড় বড় হাসকিং মিলগুলোর সঙ্গে টিকে থাকতে পারছে না। ফলে চালের বাজার হয়ে গেছে মনোপলি। একচেটিয়াভাবে বড় বড় চালকল মালিকরা তা দখল করে নিয়েছে। গুটি কয়েক চালকল মালিকরা নিজেদের ইচ্ছে মতো করে চালের দাম নির্ধারণ করে। তাই চালের দাম বাড়ে।
অন্যদিকে সরকার সীমিত পরিসরে স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রি করছে, তা সামগ্রিক বাজারকে করতে পারছে না নিয়ন্ত্রণ। চালের দাম বাড়ার ফলে প্রান্তিক কৃষকরাও কিন্তু লাভবান হচ্ছে না। ধান-চালের ব্যবসাটা কোটি কোটি টাকার মালিকরা নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থ্যাৎ ধান থেকে চাল বানানোর কাজটি করছে বড় বড় কোম্পানির সিস্টার কনর্সান কোম্পানিগুলো। এই কোম্পানিগুলো বাজার থেকে ফড়িয়া বা পাইকারদের মাধ্যমে ধান কিনে নিয়ে মজুত করে। তারপর একটি নির্দিষ্ট সময়ে চাল বানায়। একপর্যায়ে নিজেদের নির্ধারিত মূল্যে তা বাজারে ডিলারের (কোম্পানির ডিলার) মাধ্যমে বিক্রি করে।
এই ধনী ধনী কোম্পানিরা তৈরি করেছে এক ধরনের সিন্ডিকেট। এটি এমন এক সিন্ডিকেট এদের ক্ষমতার হাত অনেক লম্বা। এখনকার চাল ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ায় এদের কাছে প্রশাসনও জিম্মি হয়ে পড়ে। বর্তমানে কৃষিব্যবস্থায় এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, প্রান্তিক কৃষকরা ধান বিক্রি করে চাল কিনে খায়। গ্রামে ঢেকির প্রচলন উঠেছে অনেক আগে। তারপর চাল ভাঙার ডিজেলচালিত, পরে বিদ্যুৎচালিত মেশিন আসে, বর্তমানে সেগুলোও ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। সুতরাং প্রান্তিক কৃষকরা যেন ধান থেকে চাল বানাতে পারে, তারা যেন ধান থেকে চাল বানিয়ে বাজারজাত করতে পারে, এমন ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটা করতে পারলে চালের বাজার পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে। মনোপলি কেউ করতে পারবে না। প্রান্তিকপর্যায়ে চাল উৎপাদন করতে না পারলে মুক্ত করা সম্ভব না চালের বাজারের সিন্ডিকেট।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার কত। বিবিএসের মতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। কোনো সূচকে এই মূল্যস্ফীতিটা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেন ৫০ শতাংশ করে। তখন ৬৮ টাকা লিটারের ডিজেল দাম বেড়ে ১১৫ টাকা হয়ে যায়। তারপর আবার সরকার প্রতি লিটার ডিজেলের দাম পাঁচ টাকা করে কমিয়ে দেন।
এখানে মূল্য বৃদ্ধির হিসাবটা কিন্তু হয়ে যায় দু রকমের, ২০২২ সালের মূল্যবৃদ্ধির হিসাবে দেখা যায় বাড়লো ৫০ শতাংশ। তারপর পাঁচ টাকা কমানোর ফলে দেখা গেলে মূল্য হ্রাস পেলো, এই হ্রাসটা অঙ্কের হিসাবে প্রায় চার শতাংশের মতো। কোনো সূচকের নিরিখে মূল্যবৃদ্ধির হার নির্ণয় করা হয়? অল্প অল্প করে গত ছয় মাসে ১ হাজার টাকার ১৩ কেজি সিলিন্ডারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে গেছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। বাস্তবে দেখা যায় ১৩ কেজি সিলিন্ডার গ্যাসের মূল্য বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে বাড়ানোর পদ্ধতিতে দেখলে দেখা যাবে এর মূল্য বেড়েছে, সর্বশেষ হিসাবে মাত্র প্রায় সাত শতাংশ।
প্রশ্ন আসতে পারে মুদ্রাস্ফীতি হলো ৯.৪১ শতাংশ? আর সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়লো ৭ শতাংশ। তাহলে মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি কী অসহনীয় পর্যায়ের রয়েছে? দেশের সমষ্টিক অর্থনীতি নানা সংকটে জড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, রিজার্ভ কমে যাওয়া, খেলাপী ঋণ বেড়ে গেছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ঋণ অবলোপন, উচ্চ আয় বৈষম্য, সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়া, বাজেট ঘাটতি মিটানোর জন্য ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা, টাকা প্রচার আর এই সমস্ত কারণে সমষ্টি অর্থনীতি সংকটের মুখে। তাছাড়া বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল আমেরিকার কোপানলে বাংলাদেশ।
তাই বৈদেশিক বাণিজ্যে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা, কমছে প্রবাসীদের আয়ও। এ রকম সমস্যার কারণে বাংলাদেশের সমষ্টিক অর্থনীতি এখন রাহুর কবলে। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে দেখা দিচ্ছে তারল্য সংকট। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তারল্যে সংকট অব্যাহত থাকলে দেখা দিবে নানা ধরনের গুজব। আর গুজবকে রটিয়ে সিন্ডিকেট বাহিনী হয়ে উঠবে তৎপর। যার ফলে বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম। এই গুজবীয় পদ্ধতিতে পণ্যের দাম বাড়লে প্রশাসন পুলিশ দিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
আয় বৈষম্যটা চরম আকারে রূপ নেয়ায়, সরকারের মুদ্রা নীতিতে মুদ্রা সংকোচন পদ্ধতিটা কার্যকর হচ্ছে না। অনেকের ধারণা মতে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের মতো রূপ নিতে চলেছে নিত্যপণ্যের বাজার। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাজারে যে কোনো পণ্যের দাম গুজবীয় কারণে হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যেত। ৭৪-এর খাদ্যাভাবটাও কিছু দেশি-বিদেশি চক্রের সৃষ্টি। বর্তমানেও নিত্যপণ্যের বাজারে ওই কালো মেঘের ঘনঘটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিছু লেবাসধারী ১৯৭৩-৭৪ সালে সরকারের ভেতর ঢুকে ছিল। অর্যদিকে তাদের নিয়ন্ত্রক আমেরিকা বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অভিগমনের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। যার ফলে ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছিল চরম সংকট। আর এই সংকটের জন্য ১৯৭৫ সালে ঘটে পট পরির্বতন। ১৯৭৫ সালের পট পরির্বতনের ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক প্রভাব বলেয়ে পরিবর্তন আসে। বর্তমান সরকারের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, কোনো দেশের কাছে সরকার নতি স্বিকার করে না। বর্তমান সরকার ভীত না কোনো পরাশক্তির হুমকিতে। তাই সরকারের বিরুদ্ধে শ্বেত ষড়যন্ত্র দেশের ভিতরে এবং বাহিরে অব্যাহত রয়েছে। এই শ্বেত ষড়যন্ত্রের অন্যতম কাজ হলো নিত্যপণ্যের মূল্যের ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর একটি দেশ। চলতি বছরের আমন মৌসুমে যে ধান উৎপাদন হয়েছে তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। কৃষির অন্যান্য পণ্য সবজি, তৈলবীজ, ডালসহ নানা ধরনের খাদ্য পণ্যের উৎপাদনে কেনো ব্যাঘাত ঘটেনি। তারপরও কেন খাদ্য পণ্যের বাজার অস্থির? বাজার অস্থির আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। জাতিসংঘ বলছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে বেড়েছে।
এ ধরনের নানা অবস্থার কারণে গুজব বাড়বে। সরকারের মন্ত্রীদের এই বিষয়ে কঠোর নজর দিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ১৯৭৫ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে।
[লেখক : উন্নয়নকর্মী]