নভেম্বর ২৪, ২০২৩ তারিখে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ‘উইমেন্স কেরিয়ার কার্নিভাল’-এ একদিনের সেশন স্পিকার হিসেবে থাকার কথা ছিল হোচিমিন ইসলামের। অনুষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ও বাইরের সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রের আন্দোলনের মুখে সেই সেশন বাতিল করা হয়। নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হোচিমিনের বিপক্ষে শুধু ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়নি, তারা একই সঙ্গে অনলাইনে এবং অফলাইনেও প্রতিবাদ জানাতে থাকে।
ইসলামিক প্র?্যাকটিশনার ফর এনএসইউ নামের একটা ফেসবুক পেজে ভিসিকে পাঠানো ই-মেইলে হোচিমিনের সেশন স্পিকার হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোকে ক্রিমিনাল একটিভিটি বলে অভিহিত করে সমকামীতাকে উৎসাহ দেয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্ত করেছে। হোচিমিন বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় এলে পরিস্থিতি খারাপ করা ছাড়াও রায়ট বাঁধিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। ইভেন্ট আয়োজকরা হোচিমিনকে গেস্ট স্পিকার করে আনার ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব পোষণ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঝামেলা এড়াতে হোচিমিনের অংশগ্রহণ রহিত করে দেয়। আয়োজকরাও হোচিমিনের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন; কিন্তু হোচিমিন সৃষ্ট ভয়-ভীতি ও হুঙ্কারের মধ্যেও কার্নিভালে অংশগ্রহণে সম্মত ছিলেন।
ইসলাম ধর্মে সমকামীতা নিষিদ্ধ; সমকামীতার অপরাধে লুত (আ.)-এর জাতির ওপর আল্লাহ রাব্বুলের গজব নেমে আসে এবং তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তাই কিছু ছাত্র সমকামীতার দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে হোচিমিনের আগমন রুদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু একজন পুরুষ শুধু রূপান্তরিত মেয়ে হওয়ার অপরাধে সমকামীতার দোষে অভিযুক্ত হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ থাকতে পারে না। হোচিমিন সমকামীতা প্রতিষ্ঠার কথা কোথাও বলেননি, তিনি কার্নিভালে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন প্রান্তিক মানুষদের ইকুইটি ব্যাসিসে কিভাবে চাকরিতে এন্ট্রি দেয়া যায় এবং কী রকম পরিবেশ তৈরি করলে সেটা কাজের জন্য ইনক্লুসিভ পরিবেশ হয়- এসব নিয়েই বক্তব্য রাখার জন্য।
ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা তার আগমনকে রোধ করেছে তাদের কখনো মাদ্রাসার বলাৎকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুনিনি। কিছু মাদ্রাসায় বলাৎকার মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে, বলাৎকারের নৃশংসতার অনেক ভিকটিম শিশু মারা গেছে। ধর্ষক শয়তানের কারসাজিকে দায়ী করে তার বিশুদ্ধতার সাফাই গাইছে, বলাৎকারের অপকর্ম গোপন রাখার জন্য ভিকটিম শিশুকে ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে শপথ করিয়েছে, ধরা পড়ে গণধোলাই খেয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে- কিন্তু বলাৎকার থামেনি। এদের সমকামী যৌনতা থামানোর কোন বক্তব্য নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির মুখ থেকে বেরিয়েছে বলে শোনা যায়নি।
বিশ্বের অসীম বিদ্যা যেখানে শিক্ষা দেয়া হয় তার নাম বিশ্ববিদ্যালয়। ভাবতে অবাক লাগে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সংকুচিত চিন্তা পরিহার করার শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ; এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন ব্যক্তির কথা শুনতেও নারাজ। যে বিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ একজন ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ কথা বলবে শুনে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়ার হুমকি দিতে পারে সেই বিদ্যালয় আর যাই হোক না কেন বিশ্বের বিদ্যালয় নয়। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এমন সংকীর্ণ মনোভাব উচ্চ শিক্ষার অন্তরায়।
তাদের এই সংকীর্ণতার এখানেই শেষ নয়, হোচিমিনকে তার মেসেজ বক্সে গালাগাল আর মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। তাদের দাবি হিজড়া এবং ট্রান্সজেন্ডারড ভিন্ন, যারা ট্রান্সজেন্ডারড তারা জন্মগত লিঙ্গকে অস্বীকার করে; অন্যদিকে হিজড়ারা লিঙ্গের ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা রূপান্তরিত হোচিমিনকে নারী বলতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের মতে, তাকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে উসকানি দেয়া হয়েছে। তাদের কথামতো হোচিমিন নারী নয়, পুরুষ; কিন্তু অনুষ্ঠানে আরও পুরুষ বক্তা ছিল, তাই পুরুষ আখ্যা দিয়ে হোচিমিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণ সহজ-সরল মনে হচ্ছে না।
ট্রান্সজেন্ডারড বা রূপান্তরকামী নারী-পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও রক্তমাংসের মানুষ, তাদেরও আবেগ-অনুভূতি আছে, তারাও আনন্দে উদ্বেলিত হয়, শোকে কাতর হয়। এরা ভিনগ্রহের কোন এলিয়েন নয়
আন্তর্জাতিক মাস্টার্স প্রোগ্রাম জেমস পি. গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথে হোচিমিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। হোচিমিনের বাড়ি বগুড়ায়, সেখানেও তাকে তার চাচার প্ররোচনায় একঘরে করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার আরেক বোন আছে, বাবা নেই, মা আছেন। এখন তাদের কোন ভাই না থাকায় চাচা সম্পত্তির ভাগ চাচ্ছে, পুরো সম্পত্তি গ্রাস করার অভিপ্রায়ে প্রতিবেশীদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে হোচিমিনদের তাড়ানোর ফন্দি এঁটেছিলেন।
যারা তাদের একঘরে করেছে, তাদের বাড়ির মেয়েরা নাকি হোচিমিনদের সকাল-বিকাল গালাগাল করত, পাড়ার দোকানদার তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করত না। চাচা এবং প্রতিবেশীদের দোষ দেয়া যায় না, কারণ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই তাকে সহ্য করতে পারছে না, চাচা বা প্রতিবেশীরা করবে কেন?
উইকিপিডিয়া অনুযায়ী ট্রান্সজেন্ডারড বা রূপান্তরিত লিঙ্গ হচ্ছে তারা যাদের মানসিক লিঙ্গবোধ তাদের জন্মগত লিঙ্গচিহ্নের বিপরীত। অর্থাৎ কেউ কেউ ছেলের শরীর নিয়ে জন্মে নিলেও মনে মনে নারী সত্তায় অবস্থান করেন এবং একসময় তাদের শরীরটাকেও নারীর দিকেই নিয়ে যায়। একইভাবে নারীর শরীর নিয়ে জন্ম নেয়ার পর কেউ কেউ মনে মনে পুরুষের সত্তায় বেঁচে থাকতে নিজেকে পরিবর্তন করে পুরুষ হিসেবে।
আবার অন্য মতে পুরুষ লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নেয়া বাচ্চার আচরণ, স্বভাব, দৈহিক গঠন, কণ্ঠস্বর মেয়েদের মতো হলে সে ট্রান্সজেন্ডার; ঠিক একইভাবে মেয়ের লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর বাকি সব পুরুষদের মতো হলে সেও ট্রান্সজেন্ডার। তবে যারা স্পষ্টভাবে নারীসুলভ বা পুরুষসুলভ নয় তারাও রূপান্তরিত লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। উইকিপিডিয়ায় আরও উল্লেখ করেছে যে, রূপান্তরিত লিঙ্গ পরিভাষাটি দ্বারা এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যে জন্মগতভাবে এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যা পুরুষ বা নারীর দৈহিক যৌন বৈশিষ্ট্য হতে আলাদা। কারো কারো লিঙ্গ নির্ধারক অঙ্গও থাকে না।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে’। আলেমদের বক্তব্য হচ্ছে সুন্দর অবয়ব আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত ও আমানত, এতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা যাবে না। যারা যৌনাঙ্গের ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাদের পরিবর্তনও শরিয়া আইনে নিষিদ্ধ। যারা খোঁড়া বা জন্মান্ধ তাদেরও চিকিৎসা করে কোন পরিবর্তন আনা যাবে না, কারণ আল্লাহতালা যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তাই সুন্দরতম অবয়ব।
কিন্তু ইদানীংকালে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, এখন কৃত্রিম হার্ট, কৃত্রিম কিডনি, কৃত্রিম হাত-পা মানুষের দেহে সংযোজন করা হচ্ছে, অন্ধদের দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে, জোড়াবদ্ধ শিশুকে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা হচ্ছে। আঁকাবাঁকা দাঁতের সারি সোজা ও মসৃণ করা হচ্ছে, কৃত্রিম দাঁত বসানো হচ্ছে, প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারাকে লাবণ্যময় করে তোলা হচ্ছে। নাস্তিক আহমদ শরীফের চোখ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এক অন্ধ হাফেজের শরীরে। অসংখ্য লোক দেহ দান করে যাচ্ছেন, মৃতদেহ থেকে বিভিন্ন অঙ্গ নিয়ে অপূর্ণ মানুষকে পূর্ণাঙ্গ করা হচ্ছে, মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করে চিকিৎসা শাস্ত্রের অধ্যয়ন হচ্ছে, ওই সব মৃতদেহের কবর হচ্ছে না। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রকে জোরালো প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষকের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছিল।
২০১৩ সালে সরকার আইন করে বাংলাদেশের হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডারড মানুষকে স্বীকৃতি দিয়েছে; তার আগে এদের কোন নাগরিকত্ব ছিল না, এরা মানুষ নামে পদবাচ্যও ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ও দিনাজপুরে তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষকে পুনর্বাসনও করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করা যায় না। পাকিস্তানও ট্রান্সজেন্ডারড বা হিজড়াদের স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের আগে ২০০৯ সালে; কিন্তু ওখানকার সমাজব্যবস্থা কোথাও কোথাও এত রক্ষণশীল যে, পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে পরিবারের সদস্যরাই ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়াদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। এরা পরিবারে স্থান পায় না, শিক্ষালয়ে সতীর্থদের কাছ থেকে টিজিং আর ধাক্কা খেয়ে অবহেলা, অনাদরে বড় হয়।
তাই এদের অধিকাংশ অশিক্ষিত; দুয়েকজন শত বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করলেও কর্ম জগতে এদের সাদরে গ্রহণ করা হয় না। ফলে ভিক্ষাবৃত্তি বা জোর করে চাঁদা আদায় করাই এদের প্রধান পেশা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা জীবনযাপনে অভ্যস্ত এদের অনেকে বেপরোয়া, ভিক্ষা না দিলে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিতে থাকে। তাই এরা শুধু বিড়ম্বনাই নয়, এদের দেখলেই প্রায় সব লোক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হোচিমিনের নামের সঙ্গে মিল রাখা হোচিমিন শারীরিক গঠনে ছেলেই ছিলেন, কিন্তু তার মনটা ছিল নারীর, তাই ধীরে ধীরে নারীতে রূপান্তরিত হন তিনি। ট্রান্সজেন্ডারড বা রূপান্তরকামী নারী-পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও রক্তমাংসের মানুষ, তাদেরও আবেগ-অনুভূতি আছে, তারাও আনন্দে উদ্বেলিত হয়, শোকে কাতর হয়। এরা ভিনগ্রহের কোন এলিয়ন নয়। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রের লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের অজুহাত দিয়ে হোচিমিন ইসলামের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ বাংলাদেশের সংবিধানেরও পরিপন্থি।
[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]