বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রপ্তানি ঝুড়িতে শুধু একটি পণ্যের আধিপত্য। একটি পণ্য দিয়ে বাজার সম্প্রসারণ করা বেশ কঠিন। চীন, ভারতসহ প্রতিশ্রুতিশীল বাজারে প্রবেশের জন্য এসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনে উদ্যোগ নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভিয়েতনাম চীনে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের টেলিফোন, মোবাইল ফোন অ্যাকসেসরিজ, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ও সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশে এসব পণ্য উৎপাদন হয় না বললেই চলে।
ভিয়েতনাম গত ২০ বছরে এ খাতে বিশ্বের রপ্তানিতে ৪৭তম থেকে দশম স্থানে উন্নীত হয়েছে এবং এর পটভূমি হিসেবে রয়েছে স্বল্প মজুরি, উৎসাহমূলক কর সুবিধা, বিশ্ববাজারের সমর্থন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পাদিত মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। স্যামসাং, এলজি ও ক্যাননের মতো বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড ভিয়েতনামে তাদের প্লান্ট স্থাপন করেছে। এ ছাড়া ইন্টেল ভিয়েতনামে প্রসেসর ও ইলেকট্রনিকস চিপস তৈরির প্লান্ট চালু করেছে। ভিয়েতনাম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ এনে সংযোজন করে ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরি করে আবার রপ্তানি করে থাকে। ভিয়েতনাম এখন বিশ্বের স্মার্টফোন উৎপাদনের একটি বড় হাব হিসেবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেরও উচিত এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সুবিধা দেয়া। যেমন ১৫ বছরের জন্য কর সুবিধা, প্রশ্নবিহীন বিনিয়োগ সুবিধা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, চীন-জাপান-ভারতসহ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন এবং বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডকে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে এ খাত দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বিশাল অবদান রাখতে পারে।
এরই মধ্যে বিশ্বের বড় কিছু ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট শুধু বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় বাজারের দিকে নজর দিয়ে এ খাতে এগিয়ে এলেও খাতটি যেন শুধু দেশের বাজারমুখী না হয়, সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারের ওপর অতিনির্ভরতা আমাদের রপ্তানি খাতের অন্যতম দুর্বলতা। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের সর্ববৃহৎ আমদানিকারক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন একক অঞ্চল যেখানে রপ্তানি হয়েছিল বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
অর্থাৎ আমেরিকা ও ইউরোপীয় অঞ্চল বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৭০ শতাংশের গন্তব্যস্থল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ পণ্যের ওপর ভারত সাফটার আওতায় ২০০৬ সাল থেকে শুল্ক সুবিধা প্রদান করলেও রপ্তানি সে হারে বাড়েনি। বাংলাদেশের দিক থেকে ভারতের অঘোষিত বিভিন্ন অশুল্ক বাধাকে এর জন্য দায়ী করা হলেও দেশের ব্যবসায়ীদের ভারতের বাজারের দিকে জোর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভারতীয় পণ্য আমদানির দিকে যত না ঝোঁক রয়েছে, বাংলাদেশী পণ্য ভারতে রপ্তানিতে তেমন উদ্যোগ নেই।
সরকারি উদ্যোগে ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে বাংলাদেশি পণ্যের বাণিজ্য মেলা আয়োজনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের তাদের পণ্য বাজারজাতের জন্য বিপণন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা, সহজ কানেক্টিভিটি, প্রায় একই সংস্কৃতির ভোক্তা শ্রেণীর উপস্থিতি, ভারত কর্তৃক প্রদত্ত ট্যারিফ সুবিধা, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়ীদের বিদ্যমান সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ যদি ভারতের এক-দশমাংশ জনসংখ্যার বাজার দখল করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হলে তাদের উৎপাদিত পণ্য ভারতের বাজারে শুল্ক মুক্তভাবে প্রবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রপ্তানি ঝুড়িতে শুধু একটি পণ্যের আধিপত্য। একটি পণ্য দিয়ে বাজার সম্প্রসারণ করা বেশ কঠিন
অন্যদিকে ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যের ওপর চীন শুল্ক সুবিধা প্রদান করলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে চীনে মাত্র শূন্য দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা চীনের মোট আমদানির মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। চীন বছরে প্রায় ২ দশমিক ৭০ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকে। শূন্য শুল্ক সুবিধা কাজে লাগিয়ে এ বাজারের ক্ষুদ্র একটি অংশও যদি দখল করা যায়, তাহলে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।
চীনে আমাদের রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ অংশজুড়ে আছে তৈরি পোশাক ও হোম টেক্সটাইল, মাছ আর চামড়া ও পাটজাত পণ্য। চীনে বাংলাদেশের মূল রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের চাহিদা সৃষ্টি করতে হলে কার্যকর কৌশল এবং বাজার সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা ও চর্চা করা প্রয়োজন। সম্প্রতি এক জরিপ থেকে জানা যায়, চীনে উচ্চ আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তারা সাধারণত চেইন স্টোর থেকে ইউরোপীয় ও স্থানীয় প্রখ্যাত ব্র্যান্ডের পোশাক ক্রয় করে থাকে। আর একটি শ্রেণী রয়েছে, যারা ফুটপাত কিংবা ছোটখাটো চেইন স্টোর থেকে স্বল্প দামের পোশাক ক্রয় করে থাকে।
চীনে মজুরি ও অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্থানীয় উৎপাদকরা কম মূল্যের পোশাক তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আর তাই চীনের বাজারে প্রবেশের জন্য চীনের ভোক্তাদের রুচি, ফ্যাশন, ডিজাইন, বাজারের কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতাদের বৈচিত্র্যময় চাহিদা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত গবেষণা করা প্রয়োজন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কর্তৃক দেশভিত্তিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সেল গঠন করে ব্যবসায়ীদের বাজার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও তথ্য প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এটা অনুধাবনযোগ্য যে বিশ্ব অর্থনীতি করোনাভাইরাস থেকে উদ্ভূত অতিমারী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এ বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটকে আরও প্রকট থেকে প্রকটতর করে তুলেছে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে পুরোপুরি বের হয়ে গেলে অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপের বাজারে বেশকিছু বাণিজ্য সুবিধা হারাবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভর না করে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র করার দিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি ইউরোপের বাইরে অন্যান্য অঞ্চলেও রপ্তানি বাজার বাড়াতে হবে। প্রসঙ্গত, এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে এ প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হবে। এরপর রপ্তানিতে এখনকার মতো শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে না।
এলডিসি-বহির্ভূত অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যেও নিয়মিত শুল্ক আরোপিত হবে। এতে রপ্তানি আয় অন্তত ৮০০ কোটি ডলার পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও তিন বছর শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত থাকবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বিদ্যমান অনেক সুবিধা হারানোর বিপরীতে কিছু সুবিধাও মিলবে। কিন্তু পরিবেশগত বিষয়সহ অনেক কঠিন শর্ত পূরণ করে তবেই সুবিধাগুলো অর্জন করতে হবে, যা অনেক চ্যালেঞ্জের।
২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরো শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ২০ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে সম্পৃক্ত হতে হবে। এটি অসম্ভব নয়, যদি আমরা অর্থনীতির চালিকাশক্তি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রার পথ সুগম করতে পারি। অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের অন্যতম প্রধান খাত পোশাক ও বস্ত্র শিল্প।
সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ শিল্পের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া বাঞ্ছনীয়। জাতীয় উন্নয়নে রপ্তানি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে গত এক দশকে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি অনেক আশাব্যঞ্জক। মাঝে কোভিডের কারণে দুই বছরের সংকট না হলে এতদিনে রপ্তানি ৮০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে যেত। সে হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এ পর্যন্ত যথেষ্ট ভালো করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি যেসব খাতে রপ্তানি বেড়েছে সেগুলোর দিকে যেমন নজর দিতে হবে, এছাড়া সম্ভাবনাময় খাতগুলোর দিকেও সার্বিক পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার, পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোং লি.]