কিশোর গ্যাং কালচার আজ এক সামাজিক ও জাতীয় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে কিশোর গ্যাং যেন নতুনরূপে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। গত ২৭ অক্টোবর রাজশাহীতে প্রকাশ্যে অস্ত্রধারী কিশোরদের উদ্দাম নাচের ভিডিও ভাইরাল হয়। তাদের মধ্যে এগারোজনকে শনাক্ত করা হলে কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে। এসব কিশোর ইতোমধ্যে গুরুতর কিছু অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটিয়েছে বলেও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
দুই বছর আগে রাজশাহীতে পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট; কিন্তু নজরদারির অভাবে কিশোর গ্যাং দ্বারা পরিচালিত অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে যশোর শহরে ২৫ থেকে ৩০টি কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি দেশের প্রধান শিল্প খাত গর্মেন্টসে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে অসন্তোষের একপর্যায়ে তাদের বেতন বৃদ্ধি করা হলেও কিছু পোশাক কারখানায় বেশ কয়েক দিন ধরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে এবং এতে মুখোশ পরে হাতে লোহার রড, লাঠি নিয়ে কিশোর গ্যাংকে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। হামলার এক পর্যায়ে তারা বেশ কিছু দামি জিনিসপত্র লুটপাটও করেছে। বেশ কিছুকাল ধরে দেশে কিশোর অপরাধ বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। পাড়া-মহল্লায় এদের সরব উপস্থিতি অনেকের নজর কাড়ে। নানাভাবে এরা তাদের সরব উপস্থিতি জানান দেয়। কখনো তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি দিয়ে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম শুরু করে। প্রাথমিক অবস্থায় এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তারা আরও বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
দেশে কিশোর গ্যাং দ্বারা সংঘটিত অপরাধ নতুন কোনো ঘটনা নয়। ২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় এক ছাত্র হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতা লোকসমক্ষে আসে। এরপর ঢাকার মোহম্মদপুরসহ দেশের নানা স্থানে হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার দায়ে বিভিন্ন সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
অপরাধী হয়ে কেউ জন্মায় না। তবে কেন কিশোর বয়সের ছেলেরা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে এর কারণ খুঁজে বের করা দরকার। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অপরাধের সাথে জড়িত কিশোরদের একটি বিরাট অংশ নিম্নবিত্তের। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোটবড় শহরে দরিদ্র পরিবারের লাখ লাখ কিশোর বড় হয় অযত্ন-অবহেলার মধ্য দিয়ে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকে ওরা হয় বঞ্চিত। প্রতিকূল পরিবেশে অবহেলা, বঞ্চনা এবং নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে এক সময় অপরাধ জগতের অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায়। কখনো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে হয়ে ওঠে বেপরোয়া। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের ছাড়াও উচ্চবিত্তের পরিবারের কিশোরদের কখনো ভয়ঙ্কর অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।
অর্থাভাব যেমন একটি কিশোরকে অপরাধ জগতে ঠেলে দিচ্ছে তেমনি অর্থের প্রাচুর্যও কখনো অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের অসর্তকতার কারণে এসব কিশোররা অসৎ সঙ্গে মেশার সুযোগ করে নিচ্ছে। নেশার ঘোরে ঘটিয়ে চলছে নানা অপরাধ, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ। এরা মা-বাবা, নিকটাত্মীয়কে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক সেবন ও বিপণনের স্বার্থে নিয়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপে গ্রুপে মারামারি হরহামেশা লেগেই আছে। আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহের এ যুগে পর্নো ভিডিও, ফেসবুক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার তাদের বিপথগামী করে তুলছে। পারিবারিক, সামাজিক অনুশাসনের অভাবে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওরা অর্থ ব্যয় করে নেশার পেছনে।
কিশোর গ্যাংয়ের কাছে রয়েছে দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি, এমনকি অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। স্মার্টফোন ব্যবহার করে এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করে পরস্পরকে হামলার নির্দেশ দিচ্ছে। স্কুল কলেজের সামনে জড়ো হয়ে ইভটিজিং করে। এদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অনেক অভিভাবক তাদের মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এসব প্রতিরোধে কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডাস্থলে পুলিশের নিয়মিত টহল দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাড়ায়-মহল্লায় বয়স্কদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশে কিশোর অপরাধ হঠাৎ শুরু হয়নি। বেশ কিছুকাল আগে থেকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক মিছিল, মিটিংয়ে এদের স্লোগান দিতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত মানের পরিবর্তনে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের নামে সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে এক স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা কিশোরদের লাগানো হচ্ছে। এরা দেশি বিদেশি রাজনীতির কিছু জানে। অথচ ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে, দেশের অপরাজনীতির নোংরা আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে কিশোরদের জীবনের বারোটা বেজে যাচ্ছে। কিশোর অপরাধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা সমাজব্যবস্থায়। সারা দেশে ১১০টি এবং ঢাকায় ৫২টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ তালিকায় থাকলেও এর বাইরে আরও অনেক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।
একটি সূত্রমতে, গত দশ-এগারো বছরে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া আলোচিত হত্যাকান্ড অনেকটাই কিশোর অপরাধীদের দ্বারা সংঘঠিত হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদারের নেতৃত্বে এরা অস্ত্র বহনসহ নানা অপরাধমূলক কাজে কিশোরদের লিপ্ত থাকার নজির রয়েছে। সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যরা দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ছিন্নমূল পরিবারের কিশোরদের অথের্র প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলে টানে আনে। সাহসী ও বুদ্ধিমান কিশোরদের মাদক বিক্রি, অস্ত্র ও বোমা বহনের মতো মারাত্মক কাজে ব্যবহার করা হয়। এ কাজের জন্য ওদের দেওয়া হয় লোভনীয় অংকের অর্থ। প্রলোভনে পড়ে কিশোররা এক সময় অপরাধ জগতের স্থায়ী সদস্য হয়ে যায়। এসব কিশোর অপরাধীদের বেশিরভাগেরই বয়স যেহেতু ১৮ বছরের নিচে, তাই আইনানুযায়ী তাদের অপরাধকে শাস্তির আওতায় আনা হলেও তা হচ্ছে লঘু। আর এরই সুযোগ নিয়ে তাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে সুযোগ পাচ্ছে সন্ত্রাসী গ্রুপ। কিশোর অপরাধীদের পেছনে মদদ দেওয়া গডফাদারদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে কিশোর গ্যাংকে নিংন্ত্রণ করা যাবে না।
বিশে^ কিশোর গ্যাং অপরাধের শুরুটা হয়েছে আঠারো শতকের শেষভাগে ইংল্যান্ডে। তবে ১৯৭০ সাল থেকে বিশ^ব্যাপী এর বিস্তার লাভ করতে থাকে। পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ শিথিল হয়ে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা, সমাজ বৈষম্য, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, একাকীত্ব, মাদকাসক্তি, অশ্লীল ও সহিংসতানির্ভর ছবি দেখা, আপত্তিকর ভিডিও গেমে আসক্তি, ভিনদেশি কালচারে অভ্যস্ততা এবং হিরোইজম প্রদর্শন কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
শিক্ষার বাইরে থাকা দেশের বিশাল অংশের কিশোর মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারে ব্যস্ত সময় কাটায় এক পরিবার-বিচ্ছিন্ন জগতে। এছাড়া শরীর চর্চা, খেলাধুলার সময় নেই আজকের সর্বস্তরের কিশোর-তরুণদের। কোনো বিনোদনমূলক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ারও ব্যবস্থা নেই ওদের। কৈশোরের মনোজগতের বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে ওরা ধাবিত হয় নিরুদ্দেশ যাত্রায়। পর্দার আড়ালে থেকে যারা এসব কাজ করেন তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর অবসান ঘটাতে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবাহ সৃষ্টি করতে সুশীলসমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের যতœশীল হতে হবে। কিশোর অপরাধ দূরীকরণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না করলে কিশোর গ্যাং কালচার স্থায়ী ব্যাধি ক্যান্সার রূপে ছড়িয়ে পড়বে। কিশোরদের রাজনৈতিক মিটিংয়ে, মিছিলে সহিংস কর্মকান্ডে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
দেশের কিশোর সম্প্রদায় একটি সুশীল সভ্য সমাজের ভবিষ্যতের কান্ডারি হয়ে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে যুগে যুগে বিশে^র মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক জাগরণের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে দেশ গড়ার মতো প্রতিটি শুভ কাজে কিশোর সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। সময়ের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে তারুণ্যের বিজয়গাথা আমাদের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করেছে। আজকের কিশোর দিনে দিনে বেড়ে পরিণত মানুষ হয়ে ওঠে।
অনুকূল পরিবেশ পেলে ধীরে ধীরে তাদের মনে চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারে। বিদ্যা-বুদ্ধি-মননে, প্রগতিশীলতায় সমৃদ্ধি লাভ করে। কিশোর দেহমনের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন শারীরিক ও মানসিক পরিচর্যা, অফুরন্ত আলোকময় পরিবেশ। দেশের অধিকারবঞ্চিত কিশোরদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বস্ত্র এবং স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি কিশোর উপযুক্ত শিক্ষা নিয়ে যোগ্যতা অনুসারে কাজ করার সুযোগ পেলে কখনই ওরা অপরাধে জড়াবে না। বল বা শাস্তি প্রয়োগ কিশোর অপরাধ দমনের স্থায়ী পথ নয়।
নিম্নবিত্তের শিশুদের জন্য স্বল্পমেয়াদি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রাম-গ্রামান্তরে প্রতিটি কিশোরের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিদান নিশ্চিত করতে হবে। কিশোরদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদন সুবিধা দিতে হবে। ছিন্নমূল কিশোরদের করতে হবে পুনর্বাসন। অপরাধ চক্রে জড়িয়ে যাওয়া কিশোরদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়াতে হবে কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্রের সংখ্যা ও গুণগত মান। শিক্ষার পাশপাশি ওদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে উন্নত চিন্তা-চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিশোর গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সামাজিক সচেতনতা। আজ ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কিশোরদের ব্যবহার করলে একদিন এরাই রাজনীতিবিদদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা এবং আগামীর উন্নত দেশ গড়ায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী]