১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর, রোববার। উটকো বিড়ম্বনা এড়াতে আগেই (পশ্চিম) পাকিস্তান জেলের ডিআইজি শেখ আবদুর রশিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যান নিজ বাসস্থানে। শেখ আবদুর রশিদ ছিলেন পাঞ্জাবের অধিবাসী। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সহমর্মী ছিলেন। ভুট্টো-সরকারের নির্দেশেই তার বাসা থেকেই এদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাকে পুলিশের অতিথি ভবন সিহালায় নেয়া হয়।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় গোড়াতেই পঁচিশে মার্চ কালরাতে গণহত্যা শুরু করার পরপরই পাকিস্তানি সামরিক চক্র ও পাঞ্জাবি শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে আটক করে। আত্মসমর্পণের দিন তথা ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) পর্যন্ত পাকিস্তানের লায়েলপুর মিয়াঁওয়ালি জেলখানায় রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। বিচারের প্রহসন। মৃত্যুদ-ের বানোয়াট খড়গ। অদূরে কবর খোঁড়ার আয়োজন। তারপর হঠাৎ গেল সব বদলে। এদিন ভয়েস অব আমেরিকার এক খবরে বলা হয়, ‘আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো গৃহবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।’
‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার লন্ডন অফিসের সংবাদেও প্রায় একই রকম তথ্য প্রকাশ করা হয়, ‘পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি কনফেডারেশন গঠনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে রাওয়ালপিন্ডি নেয়া হয়েছে। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য ভুট্টো চীনা ও মার্কিন প্রতিনিধিকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’
যদিও পাকিস্তান রেডিও বলেছে, ‘সম্প্রতি রাওয়ালপিন্ডিতে দু’ নেতার মধ্যে সাক্ষাৎ হয়েছে।’ কিন্তু বিস্তারিত কিছুই বলা হয়নি।
এদিন হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২২টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ইউরোপের দেশ।’ তবে দেশগুলোর নাম এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
জাপানের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ‘আসাহি’-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বের সব দেশের সরকারের কাছে, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবতা মেনে নিতে এবং স্বীকৃতি দিতে আবেদন জানান। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি জাপানসহ বিশ্বের সব দেশের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করতে আহ্বান জানাই। বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। আমাদের সরকারের কার্যক্রমও এখন দেশজুড়ে শুরু হয়েছে। আমরা আশা করি অদূর ভবিষ্যতে আমরা উন্নত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারব। আমাদের জনগণের অসীম আত্মত্যাগই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।’
তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, ‘মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈনিকদের পুনর্গঠন করে তাদের জাতীয় সামরিক বাহিনীতে পরিণত করা হবে।’
মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ কবে দেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মুক্তিবাহিনীকে এখনই অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেয়া হবে না। তবে তারা যদি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয় তবে তা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে।’
একইদিন বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নবীন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমাদের দেশের পররাষ্ট্র নীতি হবে সবাই দেশের সঙ্গে সহাবস্থান। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সবাই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। কেউ আমাদের ওপর আক্রমণ করলে তবেই আমরা পাল্টা আক্রমণ করবো। আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে তখন আমরা পাল্টা আঘাত করতে দ্বিধা বোধ করব না। অন্যথায় আমাদের অবস্থান হবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক।’
গণমাধ্যমের খবর ও প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের মধ্যেই এদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত নিজ নিজ দেশের প্রতি আহ্বান জানান। ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে পাওয়া একটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো ব্রিটেনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছে। স্থানীয় প্রাক্তন কূটনীতিক মিশনের অফিসে এরই মধ্যে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এই দেশগুলো এখনো কোনো যোগাযোগ করেনি।
এদিকে, এদিন ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সংবাদ সম্মেলনে সফররত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি. পি. ধর (দুর্গাপ্রসাদ ধর) বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ভারত সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এ দূত বলেন, ‘সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। দেশের স্বনামধন্য প্রকৌশলী, চিকিৎসক, লেখক, বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের হত্যা করেছে।’
মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ডি. পি. ধর বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধেই ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে এসেছেন। তারা বাংলাদেশে কতদিন থাকবেন সেটা বাংলাদেশ সরকারই ঠিক করবেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একদিনও ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশে থাকবে না।’ বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও টেলিযোগাযোগ প্রসঙ্গে ডি. পি. ধর বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সড়ক, রেল ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ঘাটতি এলাকায় সরবরাহ পাঠানো শিল্প কল-কারখানা চালু রাখা, কাঁচামাল সরবরাহকে সুনিশ্চিত করার জন্য নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের কারণে যেহেতু বাংলাদেশ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকদের হারিয়েছে, তাই ভারত যন্ত্র প্রকৌশলীদের বাংলাদেশে প্রেরণ করে এই ঘাটতি পূরণ করার ব্যবস্থা নেবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এরই মধ্যে চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন সরানো শুরু হচ্ছে। শীঘ্রই অন্যান্য বন্দরগুলোতেও এই কাজ শুরু হবে। হার্ডিঞ্জ সেতুর দ্রুত মেরামত কাজ শুরু হয়েছে।’
যুদ্ধবন্দিদের বিষয়ে ডি. পি. ধর বলেন, ‘যুদ্ধবন্দী সম্পর্কিত বিষয়ে ভারত জেনেভা চুক্তিসহ সবাই প্রকার আন্তর্জাতিক বিধি মেনে চলবে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসারে সামরিক যুদ্ধবন্দিদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে তদন্ত চলছে। এর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। বাংলাদেশের গণহত্যার জন্য দায়ী বেসামরিক ব্যক্তিরা জেনেভা চুক্তির আওতায় আশ্রয় পেতে পারে না। তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। বাংলাদেশ সরকারই তাদের বিচার করবেন।’ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে ডি. পি. ধর সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ইতোমধ্যেই বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আগ পর্যন্ত ভারত প্রচেষ্টা থামাবে না। ভারতের ফলপ্রসূ আলোচনার কারণে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া ফেডারেশন)ও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করছে।’
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর অখ- পাকিস্তানের দাবি প্রসঙ্গে ভারত সরকারের এ প্রতিনিধি বলেন, ‘অখ- পাকিস্তানের কথা বলা এখন দিবাস্বপ্নের মতো। কয়েকটি রাষ্ট্রের প্ররোচনায় ভুট্টো এই স্বপ্ন দেখছে।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত তথ্য ভা-ার থেকে জানা যায়, কাঠমা-ুতে পাকিস্তান দূতাবাসে নিযুক্ত প্রথম সচিব ও বাঙালি কূটনীতিবিদ এ. কে. এম. মুসলেহউদ্দিন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) ও ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শামসুদ্দিন মোল্লা এক বিবৃতিতে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামীর আল-বদর, আল-শাম্স ও রাজাকার কর্তৃক পরিচালিত ব্যাপক গণহত্যার বিচার অনুষ্ঠানের উদ্দেশে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা ঢাকার সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং তাদের প্রায় সবাইই খুনীদের হাতে প্রাণ হারান।
শামসুদ্দিন মোল্লা আরো বলেন, ‘শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের এই অমানসিক ও লোমহর্ষক হত্যাকা- ফেরাউন, নমরুদ ও হিটলারের বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সারাবিশ্ব এসব প্রতিভার হত্যাকা-ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। সোনার বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজকে নির্মূল করাই ছিল দখলদার বাহিনীর সর্বশেষ নৃশংস হত্যাকা-ের উদ্দেশ্য। তাদের পৈশাচিক অভিযানের শিকারে পরিণত হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, দৈনিক সংবাদের শহীদুল্লাহ কায়সার, বার্তা সংস্থা ‘পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (পিপিআই)’ এর নিজাম উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং আরও অনেকে।’
এদিন দুপুরে একটি ভারতীয় সামরিক বিমান ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল শ্যাম মানেকশ’। এ সময় অধুনালুপ্ত তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আব্দুস সামাদ আজাদ। ইয়াহিয়া-বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর জেনারেল মানেকশর এটিই প্রথম ঢাকা সফর। অন্যদিকে, এদিন সাবেক পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি এ. কে. এম. নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
[লেখক : সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা]