আওয়ামী লীগ সরকারের হামলা ও একাধিক মিথ্যা মামলায় শিকার হয়েও রাজপথ থেকে সরে যায়নি। মিথ্যা মামলায় জেলও খেটেছেন অনেকবার। কিন্তু জেল থেকে বের হয়ে রাজপথে ছিলেন অনড়। কখনো বিচলিত হননি। কি পাবেন, কি পাবেন না, সেই আশায় তিনি রাজনীতি করেননি। জাতীয়তাবাদীর চেতনায় ধারণ করে পথ চলেছেন। তিনি হলে ঝালকাঠি জেলার ১ আসনের দুইবারের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল। তিনি সম্প্রতি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন ’সকলের সংবাদ’ সিনিয়র রিপোর্টার রমজান আলীর সাথে।
সকলের সংবাদ: কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
রফিকুল ইসলাম জামাল: একটা দেশের অনগ্রসর জাতিকে সম্মুখ লাইনে আনার জন্য কোটা ব্যবস্থা সারা পৃথিবীতেই আছে। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল ছাত্রদের একটা ন্যায্য দাবি। তাদের বৈষম্য বিরোধী এই দাবি সরকারকে প্রথম দিকেই মেনে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা জানি ফ্যাসিস্টরা কখনোই কোন কিছুর রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করে না। তারা কথা বলে বন্দুকের নলে। বিনা ভোটের প্রধানমন্ত্রী ছিল শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তার শপথ ভঙ্গ করেছিলেন। সংবিধানে বলা আছে একজন প্রধানমন্ত্রীর রাগ-অনুরাগ থাকতে পারে না।
তখন তিনি রাগ দেখিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে কোন কোটা থাকবে না। এটা বলার মধ্য দিয়েই তিনি বড় অনিয়ম করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনকালীন সময় কোটা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে তখন তিনি কোটা তুলে দিয়েছিলেন। আবার সেটা বাতিল করতে পুনরায় হাইকোর্টের ষড়যন্ত্রমূলক রিট করেন, কোটার যে দাবিটা তিনি মেনেছিলেন, সেটা আবার অবৈধ ঘোষণা করলেন। ফ্যাসিস্ট সরকার সবকিছু বন্দুকের নলে না; হলে বিচারপতিদের ঘাড়ে ভর করে সকল কার্যক্রম বৈধতা নেওয়ার অপচেষ্টা করেছে। আন্দোলনের শুরু থেকেই যদি ছাত্রদের সঙ্গে বসে কোটা সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে ফয়সালা নিতেন তাহলে হয়তো এমন হতো না। তবে আমাদের ছাত্ররা মেধাবৃত্তিকভাবে এই আন্দোলনকে সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তারা সবসময় বলেছে কোটা সংস্কার বাতিল নয়।
সকলের সংবাদ: কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপির অবস্থান কি ছিল?
রফিকুল ইসলাম জামাল: আপনারা জানেন যে শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে প্রথমে ছাত্রলীগ দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপরে অত্যাচার নির্যাতন করেছে। এ সময় তারা দেশি অস্ত্র লাঠিসোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ছাত্রদেরকে আহত করে হল থেকে বের করে দেয়। সে কারণেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা ঐক্য চলে আসে। তখন বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা আমাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেই।
শুরু থেকেই এ আন্দোলনে বিএনপির নীতিগত সমর্থন ছিল। পরবর্তীতে আমরা দেখলাম শুধু ছাত্রলীগ নয়, শেখ হাসিনার পোষা পুলিশ লীগ, র্যাব ও বিজিবি নামিয়ে নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করেছিল। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে হত্যা করছিল। তখনই আমাদের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ নেতা তারেক রহমানের নির্দেশক্রমে বলেছেন আমরা সশরীরে আমাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়াবো। সেই থেকেই এই আন্দোলনে আমরা সম্পৃক্ত হয়েছি।
সকলের সংবাদ: শেখ হাসিনার দেশত্যাগ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
রফিকুল ইসলাম জামাল: এই আন্দোলনে যখন সারা দেশের মানুষ ব্যাপকভাবে সমর্থন দিচ্ছে, তখন শেখ হাসিনা নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। যে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০১৪ সালে আমাদেরকে আগুন সন্ত্রাসী বলেছিলেন। ঠিক তেমনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মেট্রোরেল, বিটিভি সেতু ভবনে আগুন লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের অগ্নি সন্ত্রাসী বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এবার তার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। তার এই অপচেষ্টা দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি। আর্মি নামিয়ে কারফিউ দিয়ে তিনি সবার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু যখন দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যরা দেখলেন, গুলির মধ্যে সবাই বুক পেতে দিচ্ছে। সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন দেশ প্রেমিক আর্মি সরাসরি বলেছে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় শান্তি মিশনে যাই বাংলাদেশে ছাত্র-ছাত্রীদের বুকে আমরা গুলি চালাতে পারব না। সে কারণেই সর্বশেষ শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। পালিয়ে যাওয়ার দুদিন আগেও তিনি দম্ভ উক্তি করে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের কন্যা দেশ ছেড়ে পালায় না’। দুদিন পরেই তিনি হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে পালান, দেশের ১৮ কোটি মানুষ ও তার দলের নেতাকর্মী কে বিপদের মুখে রেখে তিনি তার জীবন নিয়ে পালিয়ে গেলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন জনগণের আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল এবং সেখানে আমাদের সমর্থন ছিল। আমরা সারা বিশ্বেই দেখেছি স্বৈরাচারের পতন হয়। স্বৈরাচারদের জনগণের প্রতি কোন আস্থা থাকে না। সে কারণেই স্বৈরাচারী সরকারগুলোর পতন হয়।
সকলের সংবাদ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিএনপির প্রত্যাশা কি?
রফিকুল ইসলাম জামাল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়েছে, এটাই আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথা বাতিল করেছিল; প্রধান বিচারপতি খাইরুল হকের মাধ্যমে। এজন্য প্রধান বিচারপতি আওয়ামী লীগ সরকারের থেকে অবৈধ সুযোগ সুবিধা নিয়েছিল। সুতরাং আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি আদায় হয়েছে। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে দেশের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করেছে। তিন মাসের মধ্যেই দেশের সকল প্রতিষ্ঠানকে জনকল্যাণমুখী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়, তাই আমরা এই সরকারকে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদে সময় দিতে চাই। যৌক্তিক মেয়াদে সময় দিতে চাই। যে সময়ের মধ্যে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। পুলিশ বাহিনী, বিচারালয়ও ব্যাপক রদবদল শুরু হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো লুট হয়ে গেছে।
সারা দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সংস্কার শুরু করেছে, এটা সফলভাবে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে তারা পূর্ণগঠন করতে সক্ষম হবে বলে আমরা মনে করি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। গণতন্ত্রের জন্য। সুতরাং এই সরকারকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যাবেনা; বিশেষ প্রয়োজনে আমরা তাদেরকে মেনে নিয়েছি। খুব দ্রুতই দেশের সার্বিক বিষয়কে পূর্ণ গঠন করে গণতান্ত্রিক সরকার উপহার দেওয়ার জন্য সুন্দর নির্বাচন দিয়ে তারা তাদের জায়গায় ফিরে যাবে। জনসাধারণের সরকার আগামীতে দেশ শাসন করবে। এটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।
সকলের সংবাদ: আপনারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন সময় দিতে চান?
রফিকুল ইসলাম জামাল: আগে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিল তিন মাস। কিন্তু ১৮ বছরের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রাষ্ট্র পূর্ণ গঠন শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আমরা মনে করি তাদেরকে ৬ মাস কিংবা তার থেকে কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। কিন্তু কোনভাবেই এটাকে বছর পার হতে দেয়া হবে না। একটা অসংবিধানিক সরকার বছর ধরে শাসন করতে পারে না। আমরা মনে করি যৌক্তিক সময়টা তাদের ছয় মাসের মধ্যে হওয়া উচিত। ছয় মাস পরেই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পরিবেশ একটা নির্বাচন দেওয়া হোক।
সকলের সংবাদ: আয়না ঘরের মতো একটা হাওয়া ভবন ছিলো, ক্ষমতায় গেলে কী আবারও হাওয়া ভবন চালু হবে ?
রফিকুল ইসলাম জামাল: আয়না ঘরে মানুষকে আটকিয়ে নির্যাতন করা হতো। হাওয়া ভবনে চেয়ারপারসন থাকতো। তাই সেই ভবনের নাম ছিলো হওয়া ভবন। সেখানে কাউকে আটকিয়ে নির্যাতন করা হতো না। কাউকে নির্যাতন করার প্রমানও নেই। কিছু মানুষ হাওয়া ভবন নামে মিথ্যা কথা রটিয়েছে।
সকলের সংবাদ: সংখ্যালঘুদের বিষয়ে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি কি?
রফিকুল ইসলাম জামাল: সমাজে আমি কাউকে সংখ্যালঘু বলতে চাই না। তারাই এই দেশেরই নাগরিক। ১৯৭১ সালে আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তখন হিন্দু মুসলমান দেখিনি। দেশ যখন পাকিস্তান ছিল তখনও হিন্দু মুসলমান দেখিনি। পাকিস্তানী হানাদাররা যখন আমাদের উপর একটি দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। তখন আমরা হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম। আমরা কাউকে সংখ্যালঘু বলতে চাই না। সংকটকালীন সময়ে কিছু কিছু সুযোগ সন্ধানী এদেরকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে, এদের কাছ থেকে লুটপাট করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইদের পাশে দাঁড়াতে আমাদের দেশ নেতা তারেক রহমান কড়া নির্দেশ দিয়েছে।
আমাদের নেতাকর্মীরা হিন্দু অধ্যাসিত এলাকায় পাহারা দিচ্ছে যাতে কোন দুষ্কৃতকারী হামলা দিতে না পারে। সংখ্যালঘু বলতে কোন শব্দ থাকবে না আমরা সকলের অধিকারই বিশ্বাস করি। আমি যে অধিকার ভোগ করি হিন্দু ভাইয়েরা একই অধিকার ভোগ করবে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই দেশে, আজকের যে সম্প্রদায়গত সমস্যা বাঙালি জাতীয়তাবাদ কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অন্যান্য ক্ষুদ্র নিগোষ্ঠীর জাতিসত্তাকে বিলুপ্ত করা করে দিয়েছিল। আমাদের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ করেছে। সুতরাং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে কোনো দূরত্ব নেই। আমরা সবাই একই দেশে সমঅধিকারে নাগরিক হয়ে গেছি। আমাদের এখানে হিন্দু-মুসলিম, খ্রিস্টান ও আদিবাসী বলে কিছু নেই।
সকলের সংবাদ: নির্বাচনী আসন নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি?
রফিকুল ইসলাম জামাল: গত ১৮ বছরেরও বেশি আমার নির্বাচনী এলাকায় ব্যক্তি স্বার্থে কাজ করেছে জনপ্রতিনিধিরা। সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে শুধু মাত্র মাদক ব্যবসার কারণে। একদিকে সন্ত্রাস অন্যদিকে মাদক ব্যবসায়ী তৈরি হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে সরকার গঠন করলে দেশ ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। সেই অঙ্গিকার নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছি।