সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি (এসআইবিপিএলসি) দেশের শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। ১৯৯৫ সালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি বা এসআইবিএলের যাত্রা শুরু হয়। ব্যাংকটির বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ ফোরকানুল্লাহ। দীর্ঘ ২২ বছর অতিবাহিত করেছি এই ব্যাংকটিতেই। তিনি ২০০২ সালের জানুয়ারিতে ফাস্ট অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ ব্যাংকে চাকরিতে যোগদান করেন। ২২ বছরের পথচলায় ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে তার । ফলে ব্যাংকে তার এক আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা, আগামীর পদক্ষেপ জানিয়েছেন সকলের সংবাদ-এর অর্থনৈতিক প্রতিবেদক সুজনকে।
সকলের সংবাদ: বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে কী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন ?
মুহাম্মদ ফোরকানুল্লাহ: বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে রিকভারি ও ওভারডিও থেকে আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি নগদ আয় বাড়ানোর প্রতি বেশি জোর দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাময়িকভাবে স্থগিত হওয়া বিভিন্ন বিল সংগ্রহের হিসাবগুলো, যেমন, ডেসকো, তিতাস, পল্লী বিদ্যুৎ, ওয়াসা, বিটিসিএল, বিআরটিএ, ডিপিডিসি, বাখরাবাদ, কর্ণফুলীসহ আরো বেশকিছুর প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদানের মাধ্যমে নগদ আয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। যা আমাদের তারল্য সংকট কাটতে সহায়তা করবে। এছাড়া আরো বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছি যার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক পুরোদমে ঘুরে দাঁড়াবে। ইন্নশাল্লাহ। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টির মাধ্যমে তারল্য সহায়তা পেয়ে গতি ফিরেছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। গ্রাহকদের পুরো টাকা না দিতে পারলেও বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটি এখন স্বল্প অঙ্কের চাহিদা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করতে পারছে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৭৯৪ কোটি টাকা বকেয়া এবং খেলাপি ঋণ আদায় করেছে এসআইবিএল। ব্যাংকটিতে সুশাসন ফিরাতে সকল ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সকল গ্রাহকের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ভালো ও মন্দ কেউকে বাদ দেয়া হচ্ছে না। ভালো ও মন্দ সবাই আমাদের গ্রাহক। সবাইকে বলছি নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে। যারা নিয়মিত দেয় না, তারাও অনেকই আশ্বাস দিয়েছে ঋণ পরিশোধ করবে। তবে যারা টাকা দিবে না তাদের ব্যাপারেও আমরা কঠোর। তাদের ব্যাপারে সকল ধরণের আইনগত ব্যাবস্থা নিতেও আমরা পিছু হটবো না।
সকলের সংবাদ: বর্তমান পর্ষদ কিভাবে সহযোগিতা করছে আপনাকে ?
মুহাম্মদ ফোরকানুল্লাহ: বর্তমানে ব্যাংকের ভালো ও নির্ভরযোগ্য বোর্ড অফ ডিরেক্টরস রয়েছে। বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা পরিষদের মধ্যে শতভাগ স্বচ্ছতা রয়েছে। এরকম বোর্ড আর্থিকখাতে সব জায়গায় দরকার। আমরা আশা করছি, সবাই মিলে শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমরা একটি অন্যতম ব্যাংক হবো। একটি ভালো ব্যাংক তৈরি করতে যা যা পরিকল্পনা দরকার সব ধরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
সকলের সংবাদ: ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?
মুহাম্মদ ফোরকানুল্লাহ: ব্যাংকটির আমানতের পাশাপাশি ও রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়াতে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। বর্তমানে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ সাড়ে ৩২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকার মতো। যা গত বছর ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকার মত। বর্তমানে রপ্তানির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশী। আমদানিতে রয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা মত। এটা বাড়ানোর চেষ্টা থাকবে। সবচেয়ে বেশি জোর দিবো খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে। এছাড়া আগের মতো গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করবো। তারল্য সংকট থাকলেও এই ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানত ও বিনিয়োগ দুটো-ই নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত। রেমিট্যান্স গ্রাহকদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর আগে যেসব রেমিট্যান্স গ্রাহক তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ আমাদের মাধ্যমে পাঠাতেন তাঁদের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করছি, যাতে তাঁরা আগের মতোই রেমিট্যান্স পাঠানো অব্যাহত রাখেন। আমাদের পরিকল্পনা হলো ক্লাসিফায়েড ও অবলোপনকৃত বিনিয়োগ থেকে আদায়ের কার্যক্রমকে আরো জোরদার করা, চলমান মামলাগুলো গতিশীল করা, স্থগিত হয়ে থাকা মামলাগুলোকে পুনরায় সচল করা। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং ক্ষেত্রভেদে তাদের নামে নতুন মামলা দেওয়া।
সকলের সংবাদ: এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে ঋণের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিবেন?
মুহাম্মদ ফোরকানুল্লাহ: আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতই শক্তিশালী ব্যক্তি হোক, ব্যাংকের টাকা ব্যাংককে, জনগণের টাকা জনগণকে ফেরত দিতে হবে। এই মোটিভ নিয়ে আমরা নেমেছি। এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে এসআইবিএল থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তার মধ্যে চলমান কিছু প্রকল্প থেকে টাকা আদায় সম্ভব এবং সেগুলো আদায়ের ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত সচেষ্ট। এই গ্রুপের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার এমটিডিআর (মেয়াদি আমানত) হিসাব আমরা এর মধ্যেই স্থগিত করে রেখেছি। এলসি খোলাসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং কার্যক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের ওপর কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল, যা পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হচ্ছে। এতে করে আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে চলেছে। আরো আশার বিষয় হলো, এস আলম গ্রুপের দখল করা ও পরিচালিত অন্য ব্যাংকগুলোর চেয়ে আমরা কিছুটা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছি।
সকলের সংবাদ: বর্তমানে ব্যাংকে কী ধরণের সেবা দিচ্ছেন?
মুহাম্মদ ফোরকানুল্লাহ: শরিয়াহ মোতাবেক সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছি। চালু রয়েছে ১৮০টি শাখা, ২৩৬টি উপশাখা, ৩৭৪টি এজেন্ট ব্যাংকিং ও ২২৪টি এটিএম বুথ। চব্বিশ ঘণ্টা এটিএম সার্ভিস ও রিয়েল টাইম অন-লাইন ব্যাংকিং চালু রয়েছে। বৈদেশিক রেমিটেন্স সেবার জন্য বিশ্বের বিখ্যাত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রেমিট্যান্স কোম্পানীর সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে। তাছাড়া আমাদের সকল শাখায় রয়েছে অন-লাইন ভিত্তিক ইউটিলিটি বিল পেমেন্ট করার সুবিধা। এসআইবিএল ১৪টি ডিপোজিট প্রোডাক্ট ও কিছু ইনভেস্টমেন্ট প্রোডাক্ট রয়েছে। একেবারেই ব্যতিক্রম এবং জনবান্ধব ডিপোজিট রয়েছে। জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ছাদ বাগানে আমরা বিনা জামানতে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ইনভেস্ট (ঋণ) রয়েছে। এটার ভাল ফল পেয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের এই ছাদকৃষিকে কৃষিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আমাদের আরেকটা প্রোডাক্ট ছিল রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিষয়ে। সাধারণত ব্যাংকগুলো নতুন গাড়িতে ইনভেস্ট করে বা ঋণ দেয়। আমরা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ওপর ইনভেস্ট করতেছি। এটাও সাধারণ মানুষের জন্য। আমরা অবসরপ্রাপ্তদের জন্য একটা প্রোডাক্ট রয়েছে। অনেকে অবসরের পর প্রলোভনে পড়ে টাকা নষ্ট করে। আমরা তাদেরকে মাসিক ভিত্তিতে লাভ বেশি দেওয়ার প্রস্তাব দেই। তাদেরকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি তার মধ্যে আছে, আমাদের কিছু হাসপাতাল আছে সেখানে তারা ভালো ডিসকাউন্টে চিকিৎসা নিতে পারে। এমনকি আমরা তাদেরকে আমাদের নিজস্ব গাড়ি দিয়ে বিনা খরচে হাসপাতালে নেওয়া-আনা করবো। এটাতেও আমরা বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। ‘হকার, ড্রাইভারদের জন্যও আমরা প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছি। অনেক ড্রাইভারকে আমরা গাড়ির মালিক বানিয়ে দিচ্ছি। আরেকটা বড় বিষয় হচ্ছে বিদেশে যাওয়ার সময় একটা ব্যাংক ব্যালান্স দেখাতে হয়। এটা সাধারণ মানুষের জন্য খুব কষ্টকর। আমরা একটা ন্যূনতম সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে তাদেরকে বড় অ্যামাউন্ট দেখানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকি।