২০১৪ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিক। অগ্রজ সহকর্মী লেখক ও সাংবাদিক মনজুরুল হক ফোন করে টোকিওর লাগোয়া বন্দরনগরী ইয়োকোহামার শিল্প জাদুঘরে যেতে বললেন। সেখানে চলছে ‘ইয়োকোহামা ট্রিয়েনালে’, জাপানের সুবৃহৎ ত্রিবার্ষিক বিশ্ব দৃশ্যকলা প্রদর্শনী। তিন মাসব্যাপী সে প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে ১৯টি দেশের ৬৫ শিল্পীর প্রায় ৪০০ শিল্পকর্ম দিয়ে। প্রদর্শনীর সমন্বয়ক ইউকো সুজুকি, শিল্প পরিচালক ইয়াসুমাসা মোরিমুরা।
ইয়াসুমাসা মোরিমুরা নিজে জাপানের অসম্ভব নন্দিত চিত্রশিল্পী। ভ্যান গঘ আর ফ্রিদা কাহলোর শিল্পকর্মের চিত্রকল্প পুনর্নিমাণ এবং তাতে নিজেকেও শিল্পের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে তিনি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। এই শিল্পী যুক্ত থাকা মানেই তাতে থাকবে ব্যতিক্রমী কোনো কিছু। সেই ব্যতিক্রমের সন্ধানই পাওয়া গেল ইয়োকোহামা ট্রিয়েনালেতে। কিন্তু সেই ব্যতিক্রমে চমকে উঠতে হলো আমাদের। কারণ, এই প্রদর্শনী উপলক্ষে মোরিমুরা শিল্পকর্ম রচনা করেছেন এবং সেটির একটি উপাদান কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’।
জাপানের শিল্প প্রদর্শনীতে ‘বিস্মরণের বই’ নামে যে বই তৈরি করা হয়। সেখানে স্থান পেয়েছিল বাঙালি কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। সেই বই থেকে ‘বিদ্রোহী’ পাঠ করছেন লেখক মঈনুল শাওন
জাপানের শিল্প প্রদর্শনীতে ‘বিস্মরণের বই’ নামে যে বই তৈরি করা হয়। সেখানে স্থান পেয়েছিল বাঙালি কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। সেই বই থেকে ‘বিদ্রোহী’ পাঠ করছেন লেখক মঈনুল শাওন
ভিন্নমাত্রিক সে প্রদর্শনীতে চমকপ্রদভাবে সংযোগ ঘটে গেল আমারও।
ইয়াসুমাসা মোরিমুরা এই প্রদর্শনীকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘বিস্মরণের সাগর সাঁতরে ফেরা’ বলে। এই বিস্মরণ জৈবিক নয়, ক্ষমতার রাজনীতির উপজাত। রাষ্ট্র আর জনতার মাঝখানে বইয়ের সূত্র ধরে সাহিত্য বা সৃষ্টিশীলতাই যেন স্মৃতি আর বিদ্রোহের জাতক। বই তাই চিরকাল রাষ্ট্রীয় রোষের শিকার। মোরিমুরা সেই কার্যকারণে পৌঁছে গেছেন কবি নজরুলের কাছে।
বড় ফন্টে বাংলা অক্ষরে লেখা ‘বিদ্রোহী’ কিনা স্থান করে নিয়েছে সারা বিশ্বের উদ্যাপিত নিয়ম ভাঙা শিল্প ও সাহিত্যকর্মের সারিতে! বিশ্বের প্রতীকী শেষ বইয়ে বাংলা ভাষার এই কবিতার অংশগ্রহণ আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
ইয়োকোহামা ট্রিয়েনালেতে মোরিমুরা তাঁর ইনস্টলেশন ও পারফরম্যান্স শিল্পকর্মের নাম দিয়েছিলেন ‘আর্ট: ফারেনহাইট ৪৫১’। নামটি মনে করিয়ে দেয় মার্কিন কল্পবিজ্ঞান লেখক রে ব্র্যাডবেরির ১৯৫০–এর দশকে প্রকাশিত ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ উপন্যাসটির কথা। ৪৫১ ফারেনহাইট এমন এক তাপমাত্রা, যাতে কাগজ টিকে থাকতে পারে না; তাতে আগুন ধরে যায়। রে ব্রেডবেরি তাঁর ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ নামের ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসে এমন এক রাষ্ট্রের কল্পনা করেছেন, যেখানে একটা একটা করে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সব বই।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে, এই প্রদর্শনীতে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ যেমন আছে, তেমনি আছে আগুনসমেত শিল্পেরও উত্তাপ। মোরিমুরা তাঁর শিল্পকর্ম গড়ে তুলেছিলেন বিরাট এক বইয়ের আদলে। যেন সেটি বিশ্বের শেষতম অবশিষ্ট বই, আর তাতে স্থান করে নিয়েছে পুনঃসম্পাদিত কিছু লেখা, ছবি আর আঁকা। প্রদর্শনীর মূল থিম হিসেবে এই শিল্পকর্ম তুলে ধরেছে রাষ্ট্রপ্রণোদিত বিস্মৃতি, বিলুপ্তি আর সেন্সরশিপকে।
বইটির প্রথম সাত অধ্যায় রচিত হয়েছে ইয়োকোহামা শিল্প জাদুঘরে। বাকি চারটি কিছুটা অদূরে, শিনকো পিয়ের নামে সাগরপারের একটি স্থানে।
চিত্রকলা, আলোকচিত্র, স্থাপনাশিল্প আর ভিডিও আর্ট দিয়ে বইয়ের আদলে তৈরি করা হয়েছিল প্রদর্শনীটি। বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় তৈরি করা হয়েছিল বিশ্বের এমন কিছু দেশের লেখা ও আঁকায়, যা কখনো না কখনো নিজ নিজ দেশের শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু বা নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে।
গ্যালারির সামনে একটি কৃত্রিম জলাধারে রাতের অন্ধকারে স্পটলাইটের আলোয় মোরিমুরার হাত থেকে বইটি গ্রহণ করলেন বিশেষ পোশাক পরা এক নারী। পানিতে তিনি হেঁটে গেলেন। আকস্মিক সরু আলোয় ধরা পড়ল কাঠের একটি নৌকা। নৌকার ওপর গ্যালারির মতোই আরেকটি কাঠের বেদি। নারীটি তার ওপর বই রাখলেন। হঠাৎ চারদিক থেকে ছুটে এল উর্দি পরা কিছু অশুভ অবয়ব। হাতে তাদের আগুনে অস্ত্র। নৌকোর কাছে গিয়ে অস্ত্র দিয়ে তারা বইটিতে আগুন ধরিয়ে দিল। এবার ছুটে এল আরও অনেকে। উন্মত্তের মতো নৌকায় রাখা আরও বই আর শিল্পকর্মে আগুন লাগিয়ে দিল তারা। পানির মাঝখানে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকল আগুন।
বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে ছিল বিশ শতকের প্রখ্যাত বেলজিয়ান শিল্পী রেনে মাগ্রিৎ আর মার্কিন কম্পোজার জন কেইজের রচনা। ছিল মার্কিন শিল্পী তারিন সাইমনের হারিয়ে যাওয়া সারি সারি মানুষের আলোকচিত্র। জাপানের ওসাকায় অবস্থিত ‘কামাগাসাকি’ নামে বিস্মরণে তলিয়ে যাওয়া একটি পুরো শহরের গল্প ছিল দ্বিতীয় অধ্যায়ে।
তৃতীয় অধ্যায়ে গিয়েই চমকে উঠে দেখতে পেলাম, বাংলার কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। মনজু ভাইয়ের ফোন পেয়ে আমি যে এই প্রদর্শনীতে ছুটে গিয়েছিলাম, তার কারণই ছিল ‘বিদ্রোহী’।
বিশ্বের সর্বশেষ গ্রন্থ
প্রদর্শনীর সমন্বয়ক ইওকো সুজুকি আমাদের নিয়ে গেলেন সুবৃহৎ জাদুঘর ভবনের দ্বিতীয় তলায় স্থাপিত প্রদর্শনীর তৃতীয় অধ্যায়ে। সেখানে একটি কক্ষের কেন্দ্রে রাখা কাঠের একটি বেদি। ছোট্ট সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে বই রাখার উঁচু ফ্রেম। তার ওপর বইটি রাখা। মোরিমুরার ভাষায়, পৃথিবীর সর্বশেষ বই। বিভিন্ন অধ্যায় মিলিয়ে পুরো বইয়ে আছে আটটি ভিন্ন ভাষার রচনা ও ছবি। বইয়ের শিরোনাম ‘মোয়ে নাই কোতো’ অথবা ‘যে কথা আগুনে পোড়ে না’।
এই বইয়ে আছে রুশ কবি আন্না আখমাতোভারও একটি কবিতা, স্তালিনের লৌহযবনিকাময় সোভিয়েত ইউনিয়নে নিষিদ্ধ হয়েও যা বেঁচে ছিল মানুষের স্মৃতিতে। আরও আছে অস্ট্রিয়ার নাট্যকার এলফ্রিডে ইয়েলিনেকের একটি নাট্যাংশ। ২০০৮ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এই নারী লেখক বাজারের করাল থাবায় পণ্যে পর্যবসিত মানুষ, অস্ট্রিয়ার ফ্যাসিস্ট অতীত এবং নারীর ওপর পিতৃতন্ত্রের পদ্ধতিগত শোষণ—এই তিন অপশক্তির বিরুদ্ধে সদা উচ্চকণ্ঠ।
প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে নিহত থাইল্যান্ডের চিত ফুমিসাকের একটি কবিতাও এখানে আছে। ১৯৩০ সালে জন্ম নেওয়া ফুমিসাক একাধারে কবি, ইতিহাসবিদ ও কমিউনিস্ট গেরিলা। থাই সামন্তবাদের বাস্তব রূপ তাঁর আলোচিত বই।
রুশ শিল্পী ভেরা মিলুতিনার আঁকা সেন্ট পিটার্সবুর্গের হেরমিতেজ আর্ট গ্যালারির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন খালি দেয়ালও এই বইয়ের অংশ।
২০১১ সালে জাপানের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পপরবর্তী জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া মিয়াগি জেলার কিতাকামি অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বও এ বইয়ে ছিল। শিগা লিকোর স্পাইরাল আলোকচিত্র সিরিজ ‘রাজেন কাইগান’–এর অংশবিশেষ ছাপা হয়েছে বইটিতে। ছাপা হয়েছে বিপ্লবী জাপানি চলচ্চিত্রকার মাসাও আদাচির হাতে আঁকা ছবি এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে তাঁর লেখা ছোট ছোট পঙ্ক্তি। আর আছে মোরিমুরার অলংকরণসহ নিজ হাতে লেখা ওকিনাওয়ার কবি নাকাইয়া কোকিচির শেষ নোট।
শিল্প প্রদর্শনীতে ‘বিস্মরণের বই’ থেকে পাঠ করছেন প্রদর্শনীর পরিকল্পক শিল্পী ইয়াসুমাসা মোরিমুরা নিজে
শিল্প প্রদর্শনীতে ‘বিস্মরণের বই’ থেকে পাঠ করছেন প্রদর্শনীর পরিকল্পক শিল্পী ইয়াসুমাসা মোরিমুরা নিজেছবি: লেখকের সৌজন্যে
‘বিদ্রোহী’র ভিন্ন উত্থান
আগেই বলেছি, মনে শিহরণ জাগিয়ে তুলল ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়া বাঙালির কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। বড় ফন্টে বাংলা অক্ষরে লেখা ‘বিদ্রোহী’ কিনা স্থান করে নিয়েছে সারা বিশ্বের উদ্যাপিত নিয়ম ভাঙা শিল্প ও সাহিত্যকর্মের সারিতে! বিশ্বের প্রতীকী শেষ বইয়ে বাংলা ভাষার এই কবিতার অংশগ্রহণ আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
মুছে ফেলতে চাওয়া ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব লেখা বা শিল্পকর্মে রচিত ‘বিস্মরণের বই’কে আয়োজকেরা বলছিলেন, প্রদর্শনীর ভেতর আরেক প্রদর্শনী। সেই ‘বিস্মরণের বই’য়ের রচনায় নজরুলের কবিতাও কিনা বড় একটি ভূমিকায় তাৎপর্যবহ হয়ে উঠল!
আকারে–প্রকারে বেশ পুরু আর বৃহদাকার এই বইয়ের নকশা করেছেন কাজুও ওয়াতানাবে। শিল্পী তোশিও ওহিও জড়িত ছিলেন বাঁধাইয়ের কাজে।
প্রদর্শনী চলাকালে সারি বেঁধে বেদিতে উঠে এই বইয়ে নজর বোলানোর ব্যবস্থা ছিল। ইয়োকোহামা ট্রিয়েনালে চলাকালে বইয়ে মুদ্রিত বিভিন্ন ভাষার রচনা অনিয়মিতভাবে পড়ে শোনানো এবং পারফর্মও করা হয়। আর এ সূত্রেই ডাক পড়ে আমার। বিভিন্ন দেশের শিল্পানুরাগীদের সামনে আমাকে পড়ে শোনাতে হবে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা।