নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ)।
শনিবার (০৮ জুন) প্রস্তাবিত ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটের উপর বিসিআই’র প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।
এদিন বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বিসিআই জানায়, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকারের ব্যায় বৃদ্ধি, কর জিডিপি অনুপাত না বাড়া ও রিজার্ভ কমার মত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের জন্য বাজেট প্রনয়ন খুবই কঠিন একটা কাজ। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ যা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রন প্রধান লক্ষ বলা হলেও টানা ১৪ মাস ধরে ৯ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যমাত্রা পূরনের পর্যাপ্ত পদক্ষেপ প্রস্তাবিত বাজেটে পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এসময় আরও বলা হয়, আমরা বাজেটে বর্তমান শিল্প সমূহকে টিকিয়ে রাখার মত কোন নির্দেশনা দেখতে পাচ্ছি না। দেশের শিল্প খাত বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিবাহিত করছে। দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহ তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে, উচ্চ মূদ্রাস্ফীতির কারনে সব প্রতিষ্ঠানের সেলস ড্রপ করেছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে নিয়মিত কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন সেবা পাচ্ছে না শিল্প সমূহ। সরকারের সংকোচন নীতির এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্রাই আপ পলিসির কারনে ব্যাংসমূহ বন্ডে বিনিয়োগের দিকে উৎসাহিত হচ্ছে আবার সরকারও ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছে। ব্যাংকের উচ্চ সুদহার এবং তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে। নতুন বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে এবছর প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বেকারত্বের বৃদ্ধি পাচ্ছে নতুন করে প্রায় ১ লক্ষ বিশ হাজার বেকার হয়েছে। এর ফলে বর্তমান শিল্প সমূহ কস্ট অব ডুইং বিজনেস বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আমদানি বিকল্প শিল্প এবং কিভাবে কারখানাগুলোর সক্ষমতা টিকিয়ে রাখার দিকে লক্ষ রাখতে হবে প্রস্তাবিত বাজেটে এর কোন দিকনির্দেশনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
আবার রপ্তানি খাতে ইপিবির তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমসের তথ্যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে না। বিজিএমইএ ও বিকেএমই এর তথ্য বিশ্লেষন করলে দেখা যায় রপ্তানি খাতের অবস্থা আশানূরুপ নয়। অন্যদিকে ইপিজেড এর শিল্পে কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির ক্ষেত্রে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। একদিকে রপ্তানি আশানুরুপ বৃদ্ধি পাচ্ছে না, রেমিটেন্সের প্রবাহ কম, রিজার্ভের স্বল্পতার মধ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অর্থনীতিকে আরো চাপে ফেলবে। আমরা এ প্রস্তাব পূনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি। আমরা রপ্তানি খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটা দিকনির্দেশনা আশা করেছিলাম এ বাজেটে। বৃহত ও মাঝারি শিল্পের সাথে দেশের মাইক্রো, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে। এমন পরিস্থিতিতে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মাইক্রো, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প খাত। প্রস্তাবিত বাজেটে মাইক্রো, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের টিকিয়ে রাখার কোন দিকনির্দেশনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
আমরা পরিবেশ ও জ্বালানি সাশ্রয় নিয়ে কথা বলি কিন্তু এবারের বাজেটে দেখছি এলইডি লাইটের উপর করারোপ করা হয়েছে। আবার দেশে উৎপাদিত এসি এবং ফ্রিজের উপর করারোপ করা হয়েছে এর ফলে এখাত ক্ষতির মূখে পড়বে এবং সর্বোপরি চাপ এসে ভোক্তার উপর পড়বে বলেও জানায় বিসিআই।
প্রস্তাবিত বাজেট নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী নয়। বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির অনুপাতে ৪ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে যা আশাব্যঞ্জক। তার পরেও ঘাটতির ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীন উৎস হতে সংগ্রহ করা হবে। আমরা মনে করি সরকারের ব্যয় কমিয়ে এবং বিদেশি উৎস হতে ঋন গ্রহনের মাধ্যমে ঘাটতি মেটানোর দিকে জোর দেওয়া উচিৎ যাতে করে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে তুলনামূলক কম হারে ঋন নেয়ার প্রয়োজন হয়। এই বিপুল অর্থ যদি ব্যাংক ও অন্যান্য অভ্যন্তরীন উৎস থেকে নেয়া হয় তাহলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে চাপ তৈরি হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রন, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন বিনিয়োগ না আসলেও বর্তমান শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অর্থ প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা অত্যান্ত জরুরী।
প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ আয়কর প্রদানে কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা হয়েছে যা বিসিআই কোন ভাবেই সমর্থন করে না। এতে করে বৈধ অর্থ উপার্জনকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন এবং এটা তাঁদের জন্য শাস্তি স্বরূপ। তাছাড়া, জমি, প্লট, ফ্ল্যাট কেনার মত অনুৎপাদশিল খাতে এ কালো টাকা ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে যা যুক্তিসংগত নয়। জমি ও ফ্ল্যাটের ক্রয়ে কালো টাকা ব্যবহার হলে জমির দাম বৃদ্ধিপাবে এবং শিল্পায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। কালো টাকা দেশের অর্থনীতিতে অন্তর্ভূক্ত করতে চাইলে সেটা শিল্প ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিৎ। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ থাকে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ জানায়, বিদ্যমান ডলারসংকট, আমদানিতে নানা ধরনের বিধিনিষেধ থাাকা, বিনিয়োগ ও উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি না হওয়া সত্ত্বেও রাজস্ব আদায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তুলনামূলক ভাবে ভালো করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি তথা করনেট বৃদ্ধি না করে শুধু বিদ্যমান করদাতাদের করহার বৃদ্ধি করে আশানুরূপ কর জিডিপি অনুপাত অর্জন করা সম্ভব নয়। দেশে টিআইএন ধারির সংখা ১ কোটির কিছু বেশি তার মধ্যে রিটার্ন দিচ্ছে ৩৯ লক্ষের মত এবং কর পরিশোধ করছে ২৬ লক্ষের মত।
বিসিআই মনে করে, কর প্রদানকারির সংখ্যা ১ কোটির উপরে থাকা উচিত। প্রস্তাবিত বাজেটে করনেট বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা থাকা উচিত বলে বলে আমরা মনে করি। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে মোট করের ৮০% এর উপর সংগ্রহ হয়ে থাকে অথচ বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৪৫ শতাংশ অন্যান্য জেলায় অবস্থিত। এসকল অঞ্চলে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মানুষের কাছে গেলে কর আদায় বৃদ্ধি পাবে এবং করনেট প্রসারিত হবে। ব্যবসায়ী এবং এনবিআরকে দায়িত্ব নিয়ে দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে এগিয়ে আসতে হবে।
সংগঠনটি আরও বলে, ব্যক্তি শ্রেণীর করমূক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা ছিল, সেটা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বর্তমান অর্তনৈতিক পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় করের সিমা ৫ লাখে উন্নিত করার প্রস্তাব পূনর্ব্যক্ত করছি। কোম্পানির জন্য করহার শর্তসাপেক্ষে ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে যা আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক হলেও এই শর্ত প্রতিপালন করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব নয় কারণ বছরে ৩৬ লক্ষ টাকা নগদ অর্থে ব্যায়ের শর্ত মানা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অসম্ভব। আমরা কোন প্রকার শর্ত ছাড়াই কর হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব পূর্নব্যাক্ত করছি। এর ফলে বিনিয়োগ আকৃষ্টে সহায়ক হবে। শর্তসাপেক্ষে এই কর ছাড় শুভংকরের ফাকি ছাড়া আর কিছু নয়।