নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের গ্রহণীয় ঋণ বাজেটের সমালোচনা করেছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম। একই সঙ্গে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি এবং উৎেসে কর কমানোর দাবি জানান ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ নেতা। এছাড়াও অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ কর দিয়ে সাদা করার সিদ্ধান্ত ভালো ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকারকে বিদেশি ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সরকারের অধিক মাত্রার ঋণের কারণে বেসরকারি খাতের ঋণে বাধা সৃষ্টি হবে। তাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’
শনিবার রাজধানীতে বাজেট পর্যালোচনা ও ব্যবসায়ীদের দাবি দাওয়া তুলে ধরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। প্রস্তাবিত বাজেটে পর্যালোচনায় এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে এফবিসিসিআই।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি ঋণ নেবে। গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই আইকন ভবনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে দেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।
এ সময় নিত্যপণ্য, চিকিৎসা সেবা, আইটিখাতসহ বাজেটে বিভিন্ন ইতিবাচক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংকটের মধ্যেও উন্নয়ন, জনকল্যাণ ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট দিয়েছে। এফবিসিসিআই মনে করে এ বাজেট বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য।’
এফবিসিসিআই সভাপতি বাজেটকে বাস্তবায়নযোগ্য বললেও তার লিখিত বক্তব্য এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবের বেশিরভাগ আলোচনা ছিল বাজেটের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দরকার সুশাসন ও যথাযথ তদারকি। এছাড়াও দরকার দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং তদারকির মান ক্রমাগতভাবে উন্নয়নের জন্য সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা ও পরিকল্পনা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করতে হবে।’
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘বাজেটে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জন্যও বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হবে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতেই হবে। তা না হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়বে।’
এ বিষয়ে আরও ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে দেশের অর্থনীতিতে এমনিই বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ বিনিময় হার, ঋণের সুদ হার, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রভৃতি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাজেট বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে আসবে ৬৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ বিশাল রাজস্ব সংগ্রহ করা সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে। এমনিতেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকসহ রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাপী বিরাজমান কঠিন পরিস্থিতির কারণে চাপের মুখে।’
তবে রাজস্ব আদায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার জরুরি বলে তিনি মত দেন। সেই সঙ্গে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়াতে করের আওতা বাড়ানো এবং উপজেলা পর্যন্ত কর অফিস বিস্তৃত করার পরামর্শ দেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ব্যক্তিখাতে করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
অগ্রিম আয়কর এবং আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম কর ব্যবসার খরচ বাড়াচ্ছে উল্লেখ করে মাহবুবল আলম বলেন, ‘এ দুটি কর বিলুপ্ত করার জন্য অনুরোধ করেছিল এফবিসিসিআই। কিন্তু করা হয়নি। অগ্রিম আয়কর যথাযথভাবে সমন্বয় না হওয়ায় ব্যবসার পরিচালন ব্যয় বাড়ে এবং চলতি মূলধনে প্রভাব পড়ে। তাই বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করছি।’
একই সঙ্গে রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে রপ্তনিতে উৎসে কর এক শতাংশ থেকে কমিয়ে শুন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ নির্ধারণের আহ্বান জানান শীর্ষ এ ব্যবসায়ী নেতা।
কর কর্মকর্তাদের কর ফাঁকি বের করতে পুরস্কৃত করা হয়। ফলে আইনের অপপ্রয়োগ হয় বলে অভিযোগ এফবিসিসিআই সভাপতির। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতা কমানোর জন্য পুরস্কার প্রথা বাতিল করে বিকল্প প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যায়। রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এডিআর পদ্ধতি চালু করার পাশাপাশি কর ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনার করার পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি কর আপিল ট্রাইব্যুনালে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগীয় সদস্যকে ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট করার আবেদনটি বিবেচনার জন্য আবারও সরকারকে অনুরোধ করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকেই বৈধ আয়ের কর না দেওয়ায় তা কালো টাকার আওতায় পড়ে গেছে। এসব অর্থ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে বাজেটে। কিন্তু অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ কর দিয়ে সাদা করার যাবে- এমন সিদ্ধান্ত ভালো ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করে না। তাই কর দিয়ে অবৈধ অর্থ সাদা করার বিষয়ে সংশোধন করা দরকার।’
অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘ইজেড হাইটেক পার্কে কারখানার মূলধনী যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী আমদানিতে এতদিন কোনো শুল্ক ছিল না। বাজেটে নতুন করে এক শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে। তাই শূন্য শুল্কের সুবিধা আরও অন্তত ৫ বছর রাখতে হবে।’