সম্প্রতি দেশে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। তন্মধ্যে ডাক্তারদের চিকিৎসা সেবা নিয়ে নানান প্রশ্ন ও বিতর্কের শেষ নেই। বর্তমান সময়ে খাবারের চেয়েও ওষুধের দাম বেশি। এদিকে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দৈনিক আয় করছেন লাখ টাকার উপরে। এমন হাজারো অভিযোগের তীর ছুড়ছেন দেশের সাধারণ মানুষ।
বিশেষ করে চট্টগ্রামের দেশ ক’জন জনপ্রিয় ডাক্তারকে দেখা গেছে, তারা দৈনিক ১ জন রোগীর পেছনে সর্বোচ্চ ২-৩ মিনিট সময় ব্যয় করেন। তন্মধ্যে তারা দৈনিক ১০০-১৫০ জন রোগী দেখেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, একেকজন ডাক্তার একেকটা প্রাইভেট হাসপাতালে এক-দেড় ঘন্টা সময় অনায়াসেই পরিবর্তন করছে।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ জন প্রতি রোগী থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৮০০-১০০০ টাকা ফিস নির্ধারণ করে আছেন। কিন্তু ৮০০-১০০০ টাকা ফিস নির্ধারণ এখানেই শেষ নয়, এর পেছনে ৫ হাজার, ৬ হাজার কিংবা ১০ হাজার টাকার একটা পরীক্ষা তো থাকবেই। অনেকের ধারণা, বর্তমানে ডাক্তারদেরও একটা অদৃশ্য সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এই সিন্ডিকেট বাণিজ্যের রোষানলে যদি রোগীকে এরকম অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগ করেন এবং অতিরিক্ত পরীক্ষা প্রয়োগ করেন, তাহলে তো দেশের সাধারণ মানুষের মৃত্যু অনিবার্য।
বর্তমানে ওষুধের মূল্য মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এতে করে দেশের সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে নাভিশ্বাস বেড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের এক রিপোর্ট সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, দেশে ওষুধের বাজারে গত ৬ মাসের মধ্যে ৩ দফায় মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। কোনো কোনো মেডিসিনের মূল্য দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। আবার দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো মেডিসিনের মূল্য দ্বিগুণ হারকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেভাবে খাদ্যপণ্যের দামও বাড়েনি। এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় খাবারের চেয়ে আসলে চিকিৎসা ব্যয় দ্বিগুণ ছাড়িয়ে কয়েকগুণ হারে বেড়ে গেছে। এভাবে ওষুধ বাণিজ্যেও অদৃশ্য সিন্ডিকেটের তৎপরতা যথেষ্ট বেড়েছে।
গত ১-২ মাসের মধ্যে ওষুধের দাম কি পরিমাণ বেড়েছে? আপনি যদি ১ বছর আগের ওষুধের দামের সাথে বর্তমানে একি ওষুধের দামের পার্থক্য হিসাব করেন, তাহলে বিশাল একটা ব্যবধান খুঁজে পাবেন।
বাংলাদেশে মূলত ৬ টি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা সবচেয়ে বেশি ওষুধ উৎপাদন করেন। গত ২০২৩ সালে দেখা গেছে যে, এসব প্রতিষ্ঠান ওষুধের দামে ১০% থেকে শুরু করে ৫০% এবং ৫৩ পার্সেন্ট পর্যন্ত অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি করেছে।
ওষুধের দামের এই উল্লম্ফন গতিতে দিশেহারা দেশের সাধারণ মানুষ। যার প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ বলছে– আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। মানুষ আছে কিন্তু মানুষ গড়ার কারিগর নেই। কারিগর থাকলেও আমাদের দুর্নীতির সীমা এতো বেশি অতিক্রম করে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, আসলে দুর্নীতি এদেশের মানুষের শিরা উপশিরায় মিশে গেছে।
বর্তমানে এমন দশা হয়েছে যে, ভেজাল খাদ্য খেতে খেতে ভালো কিছু খেলেই দেখা যাচ্ছে আমরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আবার অনেক সময় দেখা যাচ্ছে যে, ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানিকে খুশি করতে গিয়ে রোগীকে ওষুধ লিখছে। মানুষের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে ডাক্তারদের অবদান নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে ডাক্তারদের কাছে অনুরোধ থাকবে যে, অন্ততপক্ষে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তারগণ ২০০ টাকা এবং এফসিপিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তারগণ ৩০০ টাকা এরকম নাগাল যোগ্য ফি নির্ধারণ করলে ডাক্তারদের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ ডাক্তাররা সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ম করে ভোগ করছেন। এর মধ্যে ডাক্তারদের ৮০০-১০০০ টাকা করে ফিস নির্ধারণ করাটা অমানবিক এবং নিঃসন্দেহে অযৌক্তিক। এতো বেশি টাকা আয় করেও কেন ডাক্তাররা সেরা করদাতা হয় না?
কিছু কিছু ডাক্তারের প্রতিদিনের আয় ৪-৫ লাখ টাকা। এরমধ্যে যারা বাজারে জনপ্রিয় উঠেছে তাদের নাম নেওয়া তো রীতিমতো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। চিকিৎসা হচ্ছে সেবা। কিন্তু আমরা চিকিৎসাকে বর্তমানে ব্যবসায় পরিণত করেছি। এদিকে মানুষ যতো টাকা খাবার না খায়, তার চেয়ে বেশি খরচ গুনতে হচ্ছে চিকিৎসা পেতে।
বর্তমানে এমন কিছু ডাক্তারও আছেন, যারা মাসে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন। দৈনিক লাকের উপরে আয় করেন এরকম ডাক্তারের সংখ্যা দেশে যথেষ্ট বেড়েছে। আবার অনেকে মূল বেতনে, সীমিত আয়ের মধ্যে জীবনযাপন করছেন এমন ডাক্তারও দেখা যায় বর্বরতার এই যুগে।
কিছু কিছু ডাক্তার আছেন দৈনিক ৪০-৫০ জন রোগী দেখেন। আবার এমন অনেক ডাক্তারও আছেন, যারা প্রতি মিনিটে ১ জন করে দৈনিক ১০০-১৫০ জন রোগী দেখেন। আসলে আমাদের ডাক্তারদের যখন যেই সময়টুকু রোগী দেখেন– সেটা যদি ১ জন রোগীকে অন্তত ৫-১০ মিনিট করে সময় দেন, তাহলে দৈনিক ৩০-৪০ জন রোগী দেখলেই যথেষ্ট হয়। কিন্তু বর্তমানে ডাক্তারদের এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে যা প্রায়ই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
এদেশে বর্তমানে দুই শ্রেণির মানুষ দেখা যায়। তন্মধ্যে একটা হচ্ছে মানুষ শ্রেণি এবং আরেকটা হচ্ছে অমানুষ শ্রেণি। বর্তমানে কিছু মানুষের কাছে অহরহ টাকা মজুত আছে এবং মানুষের কাছে টাকার অভাব নেই। এরমধ্যে আমরা যাদের কাছে টাকা নেই, তারা কিন্তু আসলে মানুষ না কারণ আমরা ওষুধই খেতে পারবো না। আমাদেরকে ভাতই খেতে হবে। নিয়ম করে হয়তো ডাল ভাত খেতে হবে নয়তো পান্তা ভাত খেতে হবে।
ধরেন, আপনি কাপড় কিনতে গেলেন। আপনার টাকা আছে তাই আপনি আড়ং থেকে কিনলেন। আরেকজনের হয়তো অঢেল টাকা আছে তাই সে হয়তো আরও এট্টু দামি কাপড় কিনলো। আর আমরা যাদের টাকা নেই, তারা কোনোরকমে নরমাল একটা কাপড় কিনে নিলাম। কাপড় কেনার ক্ষেত্রে সেই সুযোগটা অন্তত দেখা যায়। কিন্তু ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে ওরকম কোনো সুযোগ আদৌ আছে কি?
মানুষের রোগ হয়েছে ওষুধ দিচ্ছে। হয়তো ওষুধের কোম্পানিটা এদিক ওদিক হতে পারে। কিন্তু ওষুধ তো খেতে হবে। মাফ নেই। যার ফলশ্রুতিতে দেশের ৯০% গরীব মানুষের প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে রীতিমতো নাভিশ্বাস বেড়েছে। এসব কথা সবাই শুনেন এবং জানেন। কিন্তু কেউই এই ডাক্তারদের সিন্ডিকেট এবং ওষুধ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে মুক্তি করতে প্রস্তুত নন।
বর্তমানে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। মানুষ আসলে কত টাকার খাবার খায়? কিন্তু বর্তমানে খাবারের খরচের চেয়ে মানুষের চিকিৎসার খরচ অতিমাত্রায় বেড়েছে।
এদিকে আসলে দেশে ওষুধ কোম্পানিগুলো উচ্চ হারে ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। যা রীতিমতো এদেশের সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তারপরও দেশের সাধারণ মানুষ ওষুধ বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কোনোরকম বাঁচার তাগিদে ধার দেনা করে হলেও প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে বাঁচা-মরার জীবন পার করছে। বর্তমানে ওষুধ এখন প্রতিটা পরিবারের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে।
দেশের বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যর দাম এতই বেড়েছে যে, যেখানে সর্বস্তরের মানুষ প্রায়ই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশের বাজার পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ওষুধ চালালে সংসার চালানো হয় না। সংসার চালালে ওষুধ চালানো হয় না। অর্থাৎ টানাপোড়েন ও অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে সাধারণ মানুষের। কেউ কেউ আবার বলছে– মানুষ ওষুধ খাবে, অমানুষরা ভাত খাবে।
সর্বোপরি– সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ডাক্তারদের আকাশচুম্বী ফি সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে দেশের ওষুধের বাণিজ্যের সিন্ডিকেট দমনে কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যাশা, দেশের ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং ডাক্তারদের ফি নির্ধারণ করা সময়ের দাবি। তবেই কেবল এদেশের সাধারণ মানুষ দু’মুঠো খেয়ে পরে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আহ্লাদ পূরণ হবে।
লেখক: এস.এম.রাহমান জিকু
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ।