হাতে বীনা ধারন করেন বলেই তাঁর নাম বীনাপাণি। বীণার সুর মধুর। পূজার্থী বা বিদ্যার্থীর মুখ নিঃসৃত বাক্য ও যেন মধুর হয় এবং জীবনও মধুর সংগীতময় হয় এ কারনেই তাঁর হাতে বীনা। মাতৃরূপে পূজিত এই বীনাপাণিই হচ্ছেন জ্ঞান, বিদ্যা ও ললিতকলার দেবী শ্রী শ্রী সরস্বতী। সরস্বতী পূজা তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের বিদ্যার্থীদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে পারিবারিকভাবেও এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কালপরিক্রমায় এ পূজা ব্যক্তি ও পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন বাঙালি হিন্দুদের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে ক্রমশ এক সার্বজনীন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের রূপ লাভ করেছে।
সরস্বতী পূজা জ্ঞানের দেবীর আরাধনা হলেও এর পেছনে রয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভগবৎ আরাধনার এক বিশেষ পদ্ধতি। জ্ঞানদায়িনী বিদ্যাদেবী সরস্বতী শ্বেত-শুভ্র বসনা। তার এক হাতে বীণা অন্য হাতে বেদপুস্তক, অর্থাৎ বীণাপাণিতে যার তিনি বীণাপাণি-সরস্বতী, আর এ থেকেই বাণী অর্চনার প্রচলন। তবে প্রথম কবে এ পূজার প্রচলন হয় তা বলা মুশকিল।
হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে সরস্বতীর রূপ-মাহাত্ম্য বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। বেদ, পুরাণ ও বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থে সরস্বতীর নানা রূপ ও প্রকৃতির বর্ণনা পাওয়া যায়। ঋগদেব বাগদেবী সর্বনিয়ন্ত্রণ ও সর্বনির্মাতা পরমেশ্বরী রূপে বর্ণিত হয়েছেন।
সরস্বতী বিদ্যার দেবী। বিদ্যা মানুষকে আলোকিত করে, মনুষ্যত্বের চোখ খুলে দেয়। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মনুষ্যত্বের চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিনিয়ত আমরা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছি বটে, কিন্তু সুশিক্ষিত হচ্ছি কই?
ব্রক্ষ্ম বৈবর্ত পুরাণে সরস্বতী দেবী সম্পর্কে বলা হয়েছে, যিনি পরমাত্মার বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এবং সর্ববিদ্যা স্বরূপা, তিনিই দেবী সরস্বতী। তিনি শ্বেত পদ্মসন্নিত অঙ্গজ্যোতিসম্পনা। মার্কেন্ডেয় পুরাণে এই দেবী বীণাপাণি, দুর্গার কন্যারূপে সরস্বতীর পরিচয় পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সরস্বতীর মাহাত্ম্য যেভাবেই বা যে রূপেই তুলে ধরা হোক না কেন, আমাদের বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতিতে সরস্বতীকে বিদ্যার দেবী হিসাবে পূজা করা হয়ে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায় সরস্বতীর যে মূর্তি পূজা করে সেই সরস্বতীর রূপ দ্বিভূজা, শ্বেত বরণী, শ্বেতাম্বরা, শ্বেতদল বাসিনী, শ্বেত হংসবিহারিণী ও বীণা পুস্তক- কমলধারিণী। দেবী সরস্বতী জ্ঞান দায়িনী, সর্বশুক্লা, তিনিবাগদপবী ও নিষ্কমা, নিত্যশুদ্ধা, বুদ্ধিদায়িনী মোক্ষদাত্রী। সরস্বতী জ্ঞান বিদ্যা ও ললিতকলার অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে ও পূজিত হয়ে থাকে।
বছর পরিক্রমায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে আবার ফিরে এসেছে মাঘী শুক্লা পঞ্চমী তিথি। প্রতিবছর এই দিনটি হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এক ব্যতিক্রমধর্মী আবেদন সৃষ্টি করে। এই দিনে তিথি অনুযায়ী বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে পূজা করে হয়ে থাকে।
এদিনটি অত্যন্ত শুভ। তাই এইদিন সনাতনধর্মালম্বী শিশুদের হাতে খড়ি, ব্রাহ্মণ ভোজন ও পিতৃতর্পণের প্রথাও চালু রয়েছে। লোকাচার অনুসারে ছাত্র-ছাত্রীরা সরস্বতী পূজার আগে কুল বড়ই খেতে পারে না। পূজার দিন তাদের কোনো কিছু লেখাও নিষিদ্ধ।
এইদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সবিতা-দুহিতা সরস্বতীর বন্দনার জন্য বিদ্যার্থী, ছাত্রছাত্রীরা এবং শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে যারা জড়িত অর্থাৎ এককথায় সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিন্দু সম্প্রদায়ের কবি, লেখক, ছড়াকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, আবৃত্তিকার, নাট্যাভিনেতা, সংগীত শিল্পী শ্বেত-শুভ্র বসন পরিহিতা দেবী সরস্বতীর পদ্মচরণে অর্পণ করেন পুষ্পাঞ্জলি।
সরস্বতী বিদ্যার দেবী। বিদ্যা মানুষকে আলোকিত করে, মনুষ্যত্বের চোখ খুলে দেয়। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মনুষ্যত্বের চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আক্ষরিক অর্থে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিনিয়ত আমরা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছি বটে, কিন্তু সুশিক্ষিত হচ্ছি কই?
তাই দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী সরস্বতীর কাছে আমাদের কামনা—সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতার পথে তিনি আমাদের পরিচালিত করুন। কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এক অসাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্ববোধে যেন আমরা আবদ্ধ হয়ে হাজার বছরের ঐতিহ্য বাঙালি সংস্কৃতিকে ধরে আমাদের দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারি। দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদ ও কল্যাণে দূর হোক সব অন্ধকার, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত বিশ্ব হোক শুভ্রময়।
লেখক : সহসভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ।