খেলাপি ঋণ আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে একটা বড় সমস্যা। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতই শক্তিশালী ব্যক্তি হোক, ব্যাংকের টাকা ব্যাংককে, জনগণের টাকা জনগণকে ফেরত দিতে হবে। এই মোটিভ নিয়ে আমরা নেমেছি। বলছিলেন দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর অন্যতম সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির (এসআইবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী জাফর আলম। ১৯৯৫ সালে এসআইবিএলের যাত্রা শুরু হয়। শুরু থেকেই ব্যাংকটি ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সূচকে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। বিভিন্ন সূচকে কয়েক ধাপ এগিয়েছে ব্যাংকটি। বর্তমানে রেমিট্যান্স আহরণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এসআইবিএল। ব্যাংটির প্রবৃদ্ধি ও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নানা বিষয় নিয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলমের সাথে কথা হয় সকলের সংবাদ এর নিজস্ব প্রতিবেদক রমজান আলী সাথে।
সম্প্রতি বিভিন্ন সূচকে বিশেষ করে রেমিট্যান্স আহরণে এসআইবিএলের প্রবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে জাফর আলম বলেন, আমি এখানে জয়েন করার পরে কিছু লিখিত ও কিছু অলিখিত পরিকল্পনা হাতে নেই। আমি এর আগে ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ২৬ বছর কর্মরত ছিলাম। ২০১৭ সালে এখানে (এসআইবিএল) ডিএমডি হিসেবে আসি। ওই সময় ১০ মাসের মতো এখানে ছিলাম। পরে মাঝখানে অন্য ব্যাংকে যাই। আবার ২০২১ সালে আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়। এখানে আগে কাজ করাতে একটা সুবিধা ছিল এখানকার জনবল সম্পর্কে আমার আগে থেকেই জানাশোনা। ক্লায়েন্ট যারা তারাও জানাশোনা, ক্লায়েন্টের ব্যবসা সম্পর্কে জানা আছে। যারা খেলাপি গ্রাহক তাদের সম্পর্কেও আমি জানি। এসব জিনিস জানা থাকায় কাজ করতে আমার বেশ সুবিধা হয়েছে। আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছিলাম অনেকাংশেই তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা ব্যাংকিং করি, এটা কিন্তু একটা আর্ট। আমরা চিন্তা করেছি ব্যাংকটাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, প্রত্যেকটা ইন্ডিকেটরে আমরা যাতে ভালো করতে পারি। প্রত্যেক জিনিসের একটা টার্গেট থাকে। আমরা আমাদের বার্ষিক কনফারেন্সে একটা টার্গেট নির্ধারণ করি। ব্যাংকিং সেক্টর অনেক সময় কিছুটা নেতিবাচক অবস্থা ছিল। মাঝেমধ্যেই এগুলো আসে। প্রত্যেকের জীবনেও আসে, প্রতিষ্ঠানেও আসে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার ঘটনার পরে আমাদের ওপরও তার একটা প্রভাব পড়ে। তখন একটা রিউমার ছড়ানো হয়— শ্রীলঙ্কার থেকেও আমাদের অবস্থা খারাপ হবে। সত্যিকার অর্থে ব্যাংকে যাদের টাকা আছে তারা এসব খবরে সাংঘাতিক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়। সে সময় অনেকেই টাকা তুলে বাসা-বাড়িতে নিয়ে রাখে বা অন্য কোনোভাবে ইনভেস্ট করে। এখন এটা ধীরে ধীরে কেটে গেছে। মানুষ আবার ব্যাংকের দিকেই ফিরেছে। আসলে মানুষকে ব্যাংকের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। ব্যাংকের চেয়ে আস্থার আর কোনো জায়গা নাই।
দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ইতিহাস ও অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন বড় বড় অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন ইসলামী ব্যাংক টিকবে কিনা। ইসলামী ব্যাংকের ইতিহাস খুব বেশি না, ৪২ বছরের। ১৯৮২ সালে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়। তখন যেটা আশঙ্কা করা হয় ইসলামী ব্যাংক টিকবে কিনা সেটাা বিপরীতে ইসলামী ব্যাংক ভালো পারফরমেন্স করে। বর্তমানে ১০টি পরিপূর্ণ ইসলামী ব্যাংক আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংক স্থাপনের জন্য এখনও কিছু আবেদন রয়েছে। অনেক ব্যাংক ইতিমধ্যে ইসলামী ব্যাংক হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো করছে। আমাদের যে ডিপোজিট আছে তার মধ্যে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা এই ইসলামী ব্যাংকগুলো হোল্ড করে। যে রেমিট্যান্স আসে তার ৫২ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। এটা মানুষের আস্থার কারণেই আসে। মানুষের আস্থা না থাকলে এটা হতো না।
তিনি বলেন, রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে ২০২২ সালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান ছিল ১৮তম। তার আগের বছর ছিল ২৬তম। ২০২৩ সালে আমাদের অবস্থান হয় দ্বিতীয়। ইসলামী ব্যাংক নাম্বার ওয়ান, আমরা নাম্বার টু। এক্সপোর্ট ও রেমিট্যান্সের গ্রোথটা খুব মার্জিনাল। আমাদের ২০০ পার্সেন্টের উপরে। আমাদের টার্গেট ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছর আমরা এনেছিলাম চার হাজার কোটি টাকা। সেই বছর আমাদের আনার টার্গেট ছিল তিন হাজার কোটি টাকা, আমরা এনেছিলাম চার হাজার দুইশ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে আমাদের টার্গেট ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে আমাদের এক বিলিয়ন পার হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, প্রথমত: আমরা গ্রাহকদের জন্য ভালো কিছু প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছি। দ্বিতীয়ত: দেশের বাইরে যে দেড় কোটি প্রবাসী আছে আমরা তাদের কর্মস্থলে গিয়ে গিয়ে তাদেরকে কনভিন্স করেছি। আমি নিজেও অনেক জায়গায় গিয়েছি, সমাবেশ করেছি। কারো সহায়তা ছাড়া একাউন্ট করার যে সিস্টেম ‘আই ব্যাংকিং’, সেটা আমরাই প্রথম চালু করি। এখন ৩৫টা দেশ থেকে আমাদের অ্যাকাউন্ট করা যায়।
ব্যাংকিং সেক্টরের খুবই সমালোচিত ‘খেলাপি ঋণ’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে একটা বড় সমস্যা। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যতই শক্তিশালী ব্যক্তি হোক, ব্যাংকের টাকা ব্যাংককে, জনগণের টাকা জনগণকে ফেরত দিতে হবে। এই মোটিভ নিয়ে আমরা নেমেছি। যার ফলাফল হচ্ছে ২০২১ সালে থেকে ২০২২ সালে, ২০২২ সালের থেকে ২০২৩ সালে আমার খেলাপি ঋণ কমে এসেছে। গত বছর (২০২২ সাল) আমাদের পাঁচ শতাংশ ছিল। ২০২৩ সালে সেটা সাড়ে চার শতাংশে নেমে এসেছে। দশমিক পাঁচ শতাংশ কমানোই অনেক বড় ব্যাপার। আগামীতে আমাদের পরিকল্পনা আছে আমরা এটা সাড়ে তিনে নিয়ে আসব।
এসআইবিএলের অগ্রযাত্রার পেছনে বেশকিছু কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে জাফর আলম বলেন, আমরা গত বছর ১৪টি ডিপোজিট প্রোডাক্ট ও কিছু ইনভেস্টমেন্ট প্রোডাক্ট হাতে নিয়েছি, যেগুলো মার্কেটে একেবারেই ব্যতিক্রম এবং জনবান্ধব। যেগুলো ছিল সাধারণ মানুষের জন্য প্রযোজ্য। যার মধ্যে অন্যতম, আমরা পরিকল্পনা করলাম, জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ছাদ বাগানে আমরা বিনা জামানতে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ইনভেস্টমেন্ট করব। এটার একটা ভালো ফলাফল পেয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের এই ছাদকৃষিকে কৃষিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আমাদের আরেকটা প্রোডাক্ট ছিল রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বিষয়ে। সাধারণত ব্যাংকগুলো নতুন গাড়িতে ইনভেস্টমেন্ট করে। আমরা রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ওপর ইনভেস্ট করলাম। এটা সাধারণ মানুষের জন্য করা। এছাড়া আমরা রিটায়ার্ড সিটিজেনদের জন্য একটা প্রোডাক্ট নিয়ে আসলাম। যারা রিটায়ার্ড করে তাদের নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটে। অনেকে রিটায়ার্ডের টাকা পেয়ে প্রলোভনে পড়ে টাকা নষ্ট করে। আমরা তাদেরকে মাসিক ভিত্তিতে লাভ বেশি দেওয়ার প্রস্তাব দেই। তাদেরকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি তার মধ্যে আছে, আমাদের কিছু হাসপাতাল আছে সেখানে তারা ভালো ডিসকাউন্টে চিকিৎসা নিতে পারে। এমনকি আমরা তাদেরকে আমাদের নিজস্ব গাড়ি দিয়ে বিনা খরচে হাসপাতালে নেওয়া-আনা করব। এটাতেও আমরা বেশ ভালো সাড়া পেয়েছি। আমরা প্রবাসীদের জন্য একটা সুবিধা দিয়েছি, যারা আমাদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাবে তারা যখন দেশে আসবে তাদেরকে বিমানবন্দর থেকে আমরা ঢাকা শহরের যে কোনো জায়গায় পৌঁছানোর ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা করছি। এটাতেও ভালো সাড়া পেয়েছি। এছাড়াও হকার, ড্রাইভারদের জন্যও আমরা প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছি। অনেক ড্রাইভারকে আমরা গাড়ির মালিক বানিয়ে দিচ্ছি। আরেকটা বড় বিষয় হচ্ছে বিদেশে যাওয়ার সময় একটা ব্যাংক ব্যালেন্স দেখাতে হয়। এটা সাধারণ মানুষের জন্য খুব কষ্টকর। আমরা একটা ন্যূনতম সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে তাদেরকে বড় অ্যামাউন্ট দেখানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকি।
ইসলামী ব্যাংক সর্বজনীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকিং শুধু সওয়াবের বিষয় এমনটা না। ধর্ম কিন্তু কল্যাণের জন্য। ইসলামী ব্যাংকিং সব মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য। ইসলামী ব্যাংকিং বা ইসলামী অর্থনীতি সর্বজনীন। মাদক জাতীয় জিনিস বা তামাকে কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের এক টাকাও ইনভেস্টমেন্ট নাই। কারণ সেটা শুধু ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আপনি অসত্য বলে ব্যবসা করবেন এটা হবে না। মাপে কম দিতে পারবেন না। লাভের আশায় দীর্ঘদিন ধরে মজুদদারি করতে পারবেন না। একজন হিন্দু ব্যবসায়ীকেও যদি চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দিতে হয় তাহলে মুসলিম-অমুসলিম সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং ইসলামী ব্যাংকিং সর্বজনীন, যা সবার জন্য কল্যাণকর। আমি একটা উদাহরণ দেই— আমাদের দেশের অনেক পরিচিত শ্যামলী পরিবহণ। তিনি কিন্তু একজন হিন্দু ব্যবসায়ী। তিনি শুরু থেকেই ইসলামী ব্যাংকের সাথে আছেন। তিনি কি সওয়াবের আশায় আছেন? তিনি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে আছেন। হয়তো বলতে পারেন, এখানে অনেক মানুষ অনেস্ট ইত্যাদি, এখানে অন্য কোনো ঝামেলা নাই— এই কারণে কিন্তু তিনি ইনভেস্ট করতেছেন। অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী আছে। এই কারণে অন্যান্য ব্যাংক আসতেছে।
দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য গাইডলাইন তৈরির প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক সূচনা হয় প্রাইভেট লিমিটেড হিসেবে। তখনকার আমলে কিছু লোক বিভিন্ন ছোট ছোট সেমিনার করতেন, মানুষকে বোঝাতেন, সেখান থেকে আস্তে আস্তে এগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর আমরাও মুরাবাহা কি, মুদারাবা কি ধীরে ধীরে শিখেছি। এখন গ্রাহকরাও তা জানে। বর্তমানে ব্যাংগুলোতেও তো আছেই। সিকিউরিটি এক্সেস কমিশনেও ইসলামী ব্যাংকের আলাদা সুপারভাইজারি কমিটি আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে আলাদা গাইডলাইন তৈরির জন্য। ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার বাড়ছে, সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য আলাদা নীতিমালা দরকার।