রমজান আলী : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংলাদেশ ব্যাংক।
সংশিষ্টরা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রানীতি, রিজার্ভ বাড়ানোসহ আর্থিকখাতকে নতুনভাবে সাজানো হবে। আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি ঋণ ছাড়ের সময় এসব সংস্কারের শর্ত দেয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘নতুন বছরে ব্যাংক খাতে তদারকি বাড়ানোসহ আর্থিক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে কঠোরভাবে কাজ করা হবে। নতুনভাবে আর্থিক খাতকে সাজানো হবে। সেখানে খেলাপি ঋণ, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক খাতে ঝুঁকি কমানোসহ অর্থনীতিতে সব বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে।’
মেজবাউল হক বলেন, ‘সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পরিচালনা পর্ষদ দেয়া হয়েছে। এটাকে সবাই ভালোভাবে নিয়েছে। তাই যাদের বেলায় সমস্যা হবে। তাদের বেলায় এ ধরনের সিন্ধান্ত নেয়া হবে।’
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হলে স্থায়ী একটা সরকার দরকার। কারণ সরকারের পরিকল্পনা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া সম্ভব হয় না। তাই এবার নির্বাচনের পর অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে বলে তিনি আশা করেন।’
মেজবাউল হক বলেন, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে টাকার সরবরাহ কমানোর পাশাপাশি নীতি সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরে কয়েকবারই ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে কাছাকাছি আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যাংকের সুদের হার বাড়নো হয়েছে। রেমিট্যান্স বাড়ানো জন্য সরকারে পাশাপাশি বেরকারিভাবে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। ফলে রেমিট্যান্স আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।’
মেজবাউল হক বলেন, ‘রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হবে। বর্তমানে ২৬ দশমিক ২২ বিলিয়ন রির্জাভ রয়েছে। গত কয়েক মাস আগে ২৪ বিলিয়নের নিচে ছিল রিজার্ভের পমিারণ। সামনে আরো বাড়বে রিজার্ভের পরিমাণ।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও কমে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে, অক্টোবরে যা ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। ইতিবাচক ধারায় প্রবাসী আয়, ২২ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৭ হাজার কোটি টাকা । যা গত নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ হাজার ১৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
মেজবাউল হক বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সব প্রকার পদক্ষেপ নেয়া হবে। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে কঠোরভাবে কাজ কার হবে। যেসব ব্যাংকের নন-পারফর্মিং লোন-এনপিএল (খেলাপি ঋণ) ৮ শতাংশের নিচে, তাদেরকে ক্যাটাগরি-১ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ৮ শতাংশের বেশি, অথচ ১১ শতাংশের কম হলে ক্যাটাগরি-২, যারা ১১ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে তাদের ক্যাটাগরি-৩। এটি ১৪ শতাংশের বেশি হলে ক্যাটাগরি-৪ বা বেশ খারাপ হিসেবে বিবেচিত হবে।’
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকায়। মোট বিতরণ করা ঋণের যা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সরকারি মালিকানাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মোট ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ খেলাপি।
বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ ৬৪ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ খেলাপি এবং বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলোর ৩৯ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ বা ৪ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৬ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের ১৯ দশমিক ২৫ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকের ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, বিডিবিএল-এর ৪৪ দশমিক ২২ শতাংশ এবং অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৪ শতাংশ। বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ২০ শতাংশ। বেসরকারি এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৬০ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৮৭ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩২ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের ৬৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ।
এছাড়া জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা এই খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ ৮০ শতাংশের বেশি, সেগুলো হলো, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড ও ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড় পেতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। তৃতীয় কিস্তির অর্থছাড় করার কথা রয়েছে আগামী জুন মাসে। এর আগে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যালোচনা করবে। তৃতীয় কিস্তির জন্য যেসব সংস্কার করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে করছাড় কমানো, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়, ভর্তুকি যৌক্তিক করার কৌশল নির্ধারণ এবং খেলাপি ঋণ কমানো।