রাজনীতিবিদরা মানুষকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলেন ঠিকই, তবে রাজনীতির মাঠে ইতিহাস সবসময় উপেক্ষিত। উপেক্ষিত না হলে যে জাতীয় পার্টি ও এরশাদের নয় বছরের অপশাসনের বিরুদ্ধে এত আন্দোলন করল যে আওয়ামী লীগ, এত সরব ছিল যারা, এমনকি ১৪ দলে বামপন্থী নেতারাও ‘নৈতিক কারণে’ কখনো জাতীয় পার্টিকে মেনে নেয়নি, তারা এখন পরস্পরের হাত ধরতে এমন ব্যাকুল হতে পারত না।
ব্যাকুলতাই বলছে, অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-ই আপাতত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিদের প্রধান লক্ষ্য। ৭ জানুয়ারি ২০২৪, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক পাটিগণিতের অনুশীলন শেষ হলো মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনের শেষ সময়ে।
জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হলো ২৬ আসন, আর নিজের নেতৃত্বে থাকা ১৪ দলের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়ল ৬টি আসন। এর ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই ৩২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকছে না। ফলে নৌকা প্রতীক পেয়েও ৩২ জন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাত্র ২১ দিনের মাথায় এসে দেখলেন তারা কোথাও নেই।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন কেমন হবে?
নৌকা পেয়েও না পাওয়ার এই খেলা নিছক পাটিগণিত। বিএনপি ছাড়া নির্বাচন মানে আওয়ামী লীগের ৩০০ আসন নিশ্চিত। কিন্তু শাসক দল তো তা চায় না। তাই পুরো নির্বাচনটাই শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অনুশীলনে যেখানে শাসক দলকে বিবেচনায় রাখতে হয়েছে বেশকিছু বিষয়।
এগুলো হলো—১. সব আসন যেন আওয়ামী লীগের ঘরে চলে না আসে, ২. সংসদে যেন একটি বিরোধী দলের ন্যূনতম চেহারা থাকে, ৩. নির্বাচনে দলের কেউ যেন ২০১৪-এর মতো বিনা ভোটে সংসদ সদস্য বনে না যায়, ৪. নির্বাচনে যেন একটা দৃশ্যমান ভোটার উপস্থিতি থাকে এবং নির্বাচন যেন দেখতে অসুন্দর না হয়।
ভোটের আগে এই জোটের খেলাটা হলো বেশ ঘটা করেই। আওয়ামী লীগের এক সময়কার মহাজোটের প্রধান মিত্রদল জাতীয় পার্টি ২০১৪ ও ২০১৮-এর আদলের বিরোধী দল। এখন আবার সেই পথে। অথচ জাতীয় পার্টি একটি ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক দল, যার এখন এরশাদের নিজ জেলা রংপুরেও কোনো আঞ্চলিক ভিত্তি নেই। কিন্তু রাজনীতি যেহেতু সব সম্ভাবনার শিল্প তাই নিশ্চিত আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সরিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের বসানো হলো শুধুমাত্র নির্বাচনী সৌন্দর্য বর্ধনের খাতিরে।
বিএনপি ছাড়া নির্বাচন মানে আওয়ামী লীগের ৩০০ আসন নিশ্চিত। কিন্তু শাসক দল তো তা চায় না…..
জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। সাথে আছে জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, জাতীয় পার্টি (জাপা), বিকল্পধারা বাংলাদেশ। নবগঠিত তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম-এর ভাগ্যে কী ঘটে তা দেখতে হবে একেবারে শেষে গিয়ে।
আসলে পাটিগণিত মোহময়। সেই মোহ অনায়াসে বাস্তব রাজনীতির বোধ ভুলিয়ে দিতে পারে। এমনকি পাটিগণিতকেই তখন রাজনীতি বলে ভ্রম হওয়া বিচিত্র নয়। আসন ভাগাভাগির পাটিগণিত সম্পূর্ণ হয়েছে। কিংবা এখনো হয়তো কিছুটা বাকি আছে।
নির্বাচনের মাঠে যারা আছেন তারা সবাই একত্র হলে পাটিগণিত মিলতে পারে, রাজনীতি মিলবে কি না, তা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রশ্ন। রাজনীতিতে অসম্ভবের স্থান নেই, আর নেই বলেই শুধুমাত্র বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার অভিপ্রায়ে কত কী ঘটল দেশের নির্বাচনী আয়োজনে। তবে এটাও সত্য যে, বিএনপি নিজেও নির্বাচন থেকে দূরে গিয়ে সেই সুযোগটা সৃষ্টি করেছে।
ক্ষমতাবানদের পেছনে গড্ডলিকা
অনেকে বলছেন আসন ভাগাভাগি যখন শেষ, তখন আর নির্বাচনের প্রয়োজন কি আছে? প্রয়োজন আছে। প্রথমত নির্বাচন করা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আর দ্বিতীয় হলো দেশে যে নির্বাচন হয় এবং ভালো করে হয় তা দেশ-বিদেশে তুলে ধরা। কিন্তু পথটা খুব মসৃণ নয়।
মিত্রদলের জোটে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সরকার দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দাপট, শাসক দলের কোন্দল আর বিবাদ, স্বতন্ত্রদের নিজস্ব ভোট ব্যাংক নিয়ে আতঙ্ক, সর্বোপরি বিভিন্ন মিত্রদল ও নিজ দলের নেতাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পারস্পরিক সংঘাত নির্বাচনে একটা আবহ তৈরি করবে বৈ কি। কেমন হবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করাই ভালো।
জাতীয় পার্টি একটি ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক দল, যার এখন এরশাদের নিজ জেলা রংপুরেও কোনো আঞ্চলিক ভিত্তি নেই….
একটি নির্বাচন হবে এবং তাতে বর্তমান শাসক দলের জয় অবধারিত। এখন শাসক দল যেভাবে চাইছে সেইভাবে বিরোধী দল সাজাবে। ২৬টি আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী, আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম এবং বিএনপি থেকে যারা নির্বাচন করছেন তারা মিলে কী করবেন সেইটা দেখাও নতুন অভিজ্ঞতা হবে দেশের জন্য।
বিএনপি নেই, তবে গণতন্ত্রের অমোঘ নিয়মে আওয়ামী লীগের জন্য বিরোধী শক্তি গড়ে তুলবার অবকাশ আছে। স্বতন্ত্ররা চাইবে নিজ গৃহ অর্থাৎ আওয়ামী লীগে ফিরতে। যদি না নেওয়া হয় তাহলে তা হবে আরেকটি দর্শনীয় এবং উপভোগ্য খেলা।
রাজনীতিতে হ্যাঁ বা না বলে কিছু হয় না, কিছু ক্ষেত্রে একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না দুটোই হতে পারে। জাতীয় পার্টি না না করে শেষ বেলায় একেবারে বড় করে হ্যাঁ করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে এবং সেইখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের রেখে যাওয়া জাতীয় পার্টি।
তবে এত সব অদ্ভুত এবং অস্বাস্থ্যকর পাটিগণিত কিন্তু রাজনীতির নিয়মেই আবির্ভূত হয়েছে। যেনতেন প্রকারে নির্বাচনী পাটিগণিতের সাহায্যে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়াই রাজনীতি।
তবে এই কথা বলতেই হবে যে, বাংলাদেশে আজ যে ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’ বিরাজমান তার মূলে আছে বিএনপির রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং এই বিপর্যয়ের থেকে লড়ে বেরিয়ে আসার প্রশ্নে নেতৃত্বের পরাজিত মনোভাব।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন