এনআরবি ব্যাংক বাংলাদেশের চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি। নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশী ব্যাংক পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি (এনআরবিবিপিএলসি)। ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু। বর্তমানে এনআরবি ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন তারেক রিয়াজ খান। এনআরবি ব্যাংকে যোগদানের আগে তিনি পদ্মা ব্যাংকের এমডি এবং সিইও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এনআরবি ব্যাংকে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তাঁর মেধা, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির নানা সাফল্য বয়ে এনেছেন। ব্যাংকটির আমানত, হিসাবধারীর সংখ্যা, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স প্রবাহ, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ও খেলাপি ঋণ আদায়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূচকে অগ্রগতি হয়েছে। ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা, আগামীর পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকলের সংবাদ- এর অর্থনৈতিক প্রতিবেদক আরিফ হোসেন।
সকলের সংবাদ: নতুন গ্রাহকরা আপনার ব্যাংকে আসবে কেন?
তারেক রিয়াজ খান: এনআরবি ব্যাংক তার পণ্য ও সেবার গুণমানের বিষয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণ। ব্যাংকে একদল মেধাবী কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা নতুন উদ্ভাবনী পণ্য এবং সেবা দিতে সক্ষম। ব্যাংকে অনুপ্রাণিত এবং উদ্যোমী কর্মকর্তারা রয়েছেন, যারা নতুন ব্যবসা অর্জন করতে সক্ষম। সর্বোপরি ব্যাংকের দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ একটি ভাল কর্পোরেট সুশাসন বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আমাদের শক্তিশালী মূলধন ও লিকুইডিটি’র পর্যাপ্ততা আছে, যা গ্রাহক পর্যায়ে আমাদের ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি সাসটেইনিবিলিটি’র বিষয়ে একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে। গ্রাহকেরদের জন্য ট্রেড অপারেশন অটোমেশন করা, কর্পোরেট ব্যাংকিং-এ নতুন নতুন সেবার সংযোজন করা, ব্যাংকের গ্রাহক সেবার মান উন্নয়ন নিরাপদ ও নির্ভুল সেবার নিশ্চয়তার বিভিন্ন ধরনের সেবা চালু রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভরশীল আধুনিক ব্যাংকে রূপান্তরিত একটি ব্যাংক এনআরবি। তাই আস্থার জায়গা থেকেই আসছে। গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর অনেক ব্যাংকই গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে হিমশিম খেয়েছে। অনেক ব্যাংক গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারেনি। সেখানে এনআরবি ব্যাংকের গ্রাহকের যতো টাকারই চেক হোক না কেন, কোনো গ্রাহকেই টাকা না দিয়ে ফেরত দেয়া হয়নি। ফলে গ্রাহকের আস্থা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে আমানত ও গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া এই ব্যাংকে শতভাগ সুশাসন রয়েছে। যতোগুলো ভালো ব্যাংক রয়েছে, সেইসব ব্যাংকের সুশাসন খুবই ভালো। সুশাসন ভালো থাকার কারণে তারা ভালো ব্যাংক হতে পেরেছে। তাই এনআরবি ব্যাংকের পর্ষদ খুবই ভালো। ব্যাংকিংয়ের প্রতিটি স্তরে সুশাসন থাকা দরকার আছে। সবাই যদি স্বাধাীনভাবে কাজ করতে পারে, তাহলে দেখা যাবে ব্যাংকিংখাতে অপরাধ অনেকটাই কমে যাবে।
সকলের সংবাদ: এ পর্যন্ত ব্যাংকের অর্জনগুলো কী কী?
তারেক রিয়াজ খান: এই ব্যাংকের অনেক অর্জন রয়েছে। এনআরবি ব্যাংক বাংলাদেশের চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি। শতভাগ প্রবাসী মালিকানাধীন এনআরবি ব্যাংক। বর্তমানে এই ব্যাংকটির আমানতর রয়েছে ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণ রয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। ২ লাখ ৩৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে। এছাড়া ক্রেডিট কার্ডে ৭৪ হাজার গ্রাহক রয়েছে। প্রতিমাসে ২৫ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসছে। এছাড়া আমাদের ব্যাংকের প্রতিবছরের আর্থিক সূচকগুলো দেখলেই বুঝা যাবে যে, প্রতিবছরই ব্যাংকের আর্থিক সূচক উন্নতি হচ্ছে। বর্তমানে পুরো ব্যাংকখাতই চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমানত বৃদ্ধি ও হিসাবধারীর সংখ্যা বৃদ্ধি মানেই গ্রাহকের পুরোপুরি আস্থা রয়েছে। এই আস্থা নিয়ে সামনে অনেক দূর এগিয়ে যাবো। এনআরবি ব্যাংকে টাকা তুলতে এসে কোনো গ্রাহক কখনো ফেরত যাননি। গ্রাহকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের আমানতের নিরাপত্তা। এনআরবি ব্যাংক সেটা সব সময় নিশ্চিত করেছে।
সকলের সংবাদ: প্রান্তিক মানুষের জন্য ক্ষুদ ঋণ দিতে অনেক ব্যাংক তেমন আগ্রহ দেখায় না সেক্ষেত্রে আপনার ব্যাংকের অবস্থা কি?
তারেক রিয়াজ খান: কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ঋণ বিতরণ রাড়ানো হবে। বর্তমানে ৭০ শতাংশ কর্পোরটে ঋণ রয়েছে। সেটাকে কমিয়ে ৫০ শতাংশে নিয়ে আসবো। সিএমএসএমই খাতে ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ নিয়ে আসবো ঋণে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অবদান অনস্বীকার্য। সার্বিক গুরুত্ব ও ঋণ ঝুঁকি বিবেচনায়, এনআরবি ব্যাংক ছোট ছোট উদ্যোক্তাদেরকে অর্থায়নে বেশ উদ্যোগী ভুমিকায় রয়েছে। আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে প্রচলিত নিয়মাচারের আলোকে ঋণদানে সচেষ্ট আছি। এছাড়া ‘গ্রামীণ গৃহঋণ’ নামে একটা ঋণ চালু রয়েছে। এখানে ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্যক্তিরা ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করতে পারছে। খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। এখানে থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি করছে অনেকেই। ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে গ্রাহকরা। গ্রামে অঞ্চলে এই টাকা দিয়ে খুব সুন্দর বাড়ি করতে পারে। এছাড়া ভালো ব্যবসায়ীদের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সব কর্পোরেটদের ঋণ দিচ্ছি না। বুঝে শুনে ঋণ দিচ্ছি। ছোট ব্যাংক তাই সাবধানে চলতে হবে। একবার হোচট খেলে পড়ে যেতে হবে।
সকলের সংবাদ: খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি এখন কী অবস্থায় আছে?
তারেক রিয়াজ খান: খেলাপি ঋণ আদায়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে একটা আইনের জটিলতা রয়েছে। সেই জটিলতা ভাঙতে সময়ের ব্যাপার। তবে ব্যাপক জোর দেয়া হচ্ছে খেলাপি ঋণ আদায়ে। গত এক বছরে আড়াইশো কোটি টাকার মতো খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছি। বর্তমানে ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ একটু বেশি রয়েছে। যা আগামী জুনের মধ্যে সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে নিয়ে আসবো। আমি আসার পর থেকে ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ বাড়েনি। ব্যাংকের খেলাপি ঋণগুলো সবই পুরানো ঋণ ছিল। আমি ব্যাংকে যোগদান করার পর থেকে নতুন ঋণ প্রদানে ঝুকি ব্যবস্থাপনা ভিত্তিক কনজারভেটিভ অ্যাপ্রোচ নিয়েছি। কর্পোরেট ঋণের পাশপাশি সিএমএসসিএমই এবং সুরক্ষিত রিটেল ঋণ যেমন, হোম লোন, কার লোন, গ্রামীণ গৃহ ঋণ উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
সকলের সংবাদ: ব্যাংকের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?
তারেক রিয়াজ খান: আমাদের ব্যাংকিং সেবাকে ‘গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড’-এ উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দিকে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে মানুষের কাছে বেশি পৌঁছানো যায়। বর্তমানে ডিজিটাল প্লাটফর্ম মানুষ বেশি পছন্দ করে। কারণ ঘরে বসে এখন মানুষ ব্যাংকিং করতে বেশি পছন্দ করে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে সরাসরি এতো গ্রাহকের কাছে যাওয়া সম্ভব না। তাই এখন ডিজিটাল উপরে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে যার যত ডিজিটাল সক্ষমতা বেশি, সেই ব্যাংকই ততো বেশি এগিয়ে যাবে। ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছানো সম্ভব। যা শাখা ও উপ-শাখা দিয়ে সম্ভব না। তাছাড়া অনেকটা খরচও কমানো সম্ভব। ‘এনআরবি ক্লিক’ নামে একটা অ্যাপস রয়েছে। এই অ্যাপসের মাধ্যমে ব্যাংকিংয়ের সকল কাজ করা যাবে। আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে মধ্যে ভালো অবস্থানে থাকবে ব্যাংকটি। এনআরবি ব্যাংকের ভালো প্রোডাক্ট রয়েছে। সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছানের জন্য কাজ করছি। কিভাবে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ানো যায়, সেই জন্য কাজ করছি। এনআরবি ব্যাংকের ঋণ দেয়া সক্ষমতা রয়েছে। তাই এ সক্ষমতা কাজে লাগাতে চাই। এছাড়া আমদানি ও রপ্তানিতে বৃদ্ধিতে জোর দিতে দিয়েছি।



