নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বলতে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রায় গচ্ছিত সম্পদের মজুতকে বোঝায়। এভাবে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে মূলত বৈদেশিক ঋণ, ঋণের সুদ ও আমদানি দায় পরিশোধে ব্যবহৃত হয়। উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একটি দেশের রিজার্ভ শূণ্য হওয়ার অর্থ হলো নিত্যপণ্য আমদানির অর্থ না থাকা। এমন পরিস্থিতির মধ্যে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানিসহ সকল নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। চড়া মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ে সে দেশের অধিকাংশ মানুষের উপর। রিজার্ভ শূণ্য দেশের সরকারের আর্থিক শক্তিও ফুরিয়ে যায় খুব দ্রুত।
সাধারণত বেশির ভাগ দেশই মার্কিন ডলারে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জমা রাখে। এছাড়া ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো, চীনা মুদ্রা, জাপানি ইয়েন, ব্রিটিশ পাউন্ড, সুইস ফ্রাঁও রিজার্ভ হিসাবে জমা রাখা হয়।
মূলত পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে একটি দেশ ডলার পায়। পাশাপাশি বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স হিসেবেও ডলার দেশে আসে। তা থেকেই মূলত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বৈদেশিক ঋণ বাবদ পাওয়া অর্থ এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের অর্থ।
একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোনো ফিক্সড বা নির্ধারিত বিষয় নয়, যে কোনো সময় তা পরিবর্তন হতে পারে। তবে রিজার্ভ একেবারে শূণ্য হওয়ার আগে যে কোনো দেশ তা রক্ষা করার জন্য বিদেশি ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করে। একইসঙ্গে রপ্তানি আয় ও বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের আয় বাড়ানোর দিকে মনযোগী হয়। এক্ষেত্রে ভালো ফলাফল পাওয়া গেলে একটি দেশ রিজার্ভ শূণ্য হয়ে ‘দেউলিয়া’ হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
এদিকে দীর্ঘ একটি সময় ধরে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এরপর সাম্প্রতি সময়ে শুরু হয়েছে ইসরায়ে-হামাসের যুদ্ধ। এর ফলে টালমাটাল পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্বজুড়ে নিত্যপণ্যের দাম চলে যাচ্ছে হাতের নাগালের বাইরে। হঠাৎ আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় টান পড়েছে বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
রাজস্ব ও বিনিয়োগ থেকে পাওয়া আয়ের মাধ্যমে নিজস্ব দেনা মেটায় কোনো দেশের সরকার। সরকারি ব্যয় লাগামছাড়া হলে একটি দেশ ঋণগ্রস্ত হয়। তখন সরকারকে আরো ঋণ নিতে হয়। ঋণ পেতে বন্ড ইস্যু করে সরকার। বন্ডের মেয়াদ পূর্ণ হলে এর সুদ ও আসল পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎস থেকে নেওয়া ঋণ মিলে হয়- জাতীয় দেনা। সরকারের ইস্যু করা বন্ডের মাধ্যমে বেশিরভাগ বাহ্যিক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া হয়, যে বন্ড কেনেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ঋণ সরকার দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয় বা জনগণের মধ্যে ঋণপত্র ইস্যুর মাধ্যমেও নিতে পারে।
সরকারের বাজেট বরাদ্দ থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করার ব্যবস্থা থাকে। এজন্য অনেক সময় সরকার টাকা বেশি ছাপায় বা করের আওতা বাড়ায়। তবে বাহ্যিক ঋণের একটি বড় বিপদ, এজন্য বাজেটে অন্যান্য রাজস্ব বৃদ্ধিকারী খাতে বরাদ্দ কমিয়ে সে অর্থ দেনা পরিশোধে রাখতে হয়। এ ঋণ শোধ করতেও হয় বৈদেশিক মুদ্রায়, যার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে ডলার সংকট। এমন পরিস্থিতির মধ্যে প্রবাসী আয়ও আসছে না আশানুরূপ। ফলে সংকট আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
প্রতি দুই মাস পর পর আমদানি দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের। এর ফলে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এতে রিজার্ভ নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের আগস্ট মাসের রেকর্ড ৪৮ বিলয়নের ডলার ছিল। মাত্র আড়াই বছরে গ্রেস রিজার্ভ নেমে আসে ২৩ বিলিয়নের ঘরে। আর ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁদিয়েছে প্রায় সোয়া ১৩ বিলিয়ন ডলার।