কৃষিঋণ বিতরণের পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিময় ব্যবসা, বাণিজ্যিক ও কৃষিভিত্তিক শিল্প বা প্রকল্প কিংবা দারিদ্র্য বিমোচনের মতো কর্মসূচিতে সরকারের সহযোগী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকারি মালিকানায় পরিচালিত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত করেন। এ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। যুগের সাথে পাল্টাচ্ছে কৃষি। সম্প্রসারিত হচ্ছে এ খাত। কৃষি এখন শুধু জমিতে মই নিরনো নয়। কৃষির আধুনিকায়ন হচ্ছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়েই বাংলাদেশে এখন কৃষি খাত এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশে খাদ্যের ঘাটতি নেই। তাই এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ বাংলাদেশ। কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আলী খান একান্ত সাক্ষাৎকারে সকলের সংবাদকে কথা জানান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সকলের সংবাদ-এর অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক রমজান আলী।
সকলের সংবাদ: কৃষি ব্যাংক কতটা কৃষক বান্ধক বলে আপনি মনে করেন?
শওকত আলী খান: কৃষি ব্যাংক সম্পূর্ণ কৃষকের ব্যাংক। এ ব্যাংক কেবল শুধু মুনাফা অর্জন নয়। দেশের কল্যাণে নিবেদিত। বাংলাদেশ আজ খাদ্য সয়ংসম্পূর্ণ। এটি একমাত্র কৃষকদের মাঝে সহজ সর্তে ঋণ দেয়ার কারণে সম্ভব হয়েছে। কৃষি ব্যাংক ঘাটতি দিয়েও কৃষকের পাশে আছে এবং থাকবে। এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠাতা হয়েছে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক সচল রাখার জন্য। এখন আগের মত কোন মানুষ অভাবে নেই। যার কোন কিছুই নেই, তারও এখন গ্রামে দুই-চারটা গরু পালন করছে। এর অবদান শুধু কৃষি ব্যাংকরেই। এভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু পালন করেও অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছে।
সকলের সংবাদ: আপনি যোগদান করার পরে তেমন কি পরিবর্তন হয়েছে ?
শওকত আলী খান: আমি যোগদান করার পরে ১০০ দিনের একটি কর্মসূচি দেই। তাতে আমানত ও ঋণ খেলাপী এবং ঋণ আদায় থেকে শুরু বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এছাড়া ১৪০টির মতো লস শাখা কমাতে সক্ষম হয়েছি। সবচেয়ে আর একটি বড় কাজ করতে পেরেছি। তা হলো ব্যাংকের ভিতরে সুশাসন ফিরিয়ে আনতেও সক্ষম হয়েছে। এরই মধ্যে যাদের ভিতরে অনিয়ম ধরা পড়ছে তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে এখন আর কেউ অনিয়ম করতে সাহস পাবে না।
সকলের সংবাদ: কৃষি ব্যাংকের কার্যক্রম গতিশীল করতে কি ভূমিকা নিচ্ছেন ?
শওকত আলী খান: কৃষি ব্যাংকের কার্যক্রম গতিশীল করতে সকল কর্মচারীর চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনের লক্ষ্যে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। প্রতিটি শাখায় অনলাইন কার্যক্রম রয়েছে। ইতোমধ্যেই ব্যাংকের সব শাখাতে অনলাইনের আওতায় আনা হয়েছে। যা আগে ছিল না। আমাদের জনবল সংকট থাকার পরও আমরা ভালো কিছু করারা চেষ্টা করছি।
সকলের সংবাদ: জনবল সংকট কাটাতে কত দিন লাগবে বলে মনে করেন?
শওকত আলী খান: পনের হাজার চার’শ বিয়াল্লিশ জনের মধ্যে নয় হাজাররের মত লোক দিয়ে বর্তমান কার্যক্রম চলছে। তবে শিগগিরই ২ হাজারের মতো জনবল যোগ হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭৯ জন অফিসার ও সি. অফিসার পদে নিয়োগ প্রদান করেছে। আশা করি এতে অনেকটা জনবল সংকট কেটে যাবে।
সকলের সংবাদ: উদ্যোক্তা বাড়াতে কি ভূমিকা নিয়েছেন ?
শওকত আলী খান: কৃষির পাশপাশি উদ্যোক্তা বাড়াতে এসএমই খাতে বেশি ঋণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন খামারীদের সহজ শর্তে ও স্বল্প মুনাফায় ঋণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া নারীরা যাতে ঘরে বসে বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্যে তৈরি করতে পারে সেই জন্য তাদের সহয়তা করা হবে।
সকলের সংবাদ: গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করতে কৃষি ব্যাংক কিভাবে কাজ করছে?
শওকত আলী খান: গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে কৃষি ব্যাংক বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি ব্যাংকে ৩৫ লাখেরও বেশি ঋণগ্রহিতা রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে ১ কোটি ৪৫ লাখেরও বেশি গ্রাহক রয়েছে ব্যাংকটিতে। কৃষক ও কৃষির সাথে সম্পৃক্ত সব ধরনের ব্যাংকিং কর্মকান্ড এখানে রয়েছে। উন্নততর কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্পে অর্থায়ন, কাচাঁমাল আমদানি, পণ্য রফতানি, রেমিট্যান্স সংগ্রহ সবই করছে। রেমিট্যান্স সংগ্রহ দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে অবস্থান এখন ৬ষ্ঠ। এছাড়াও কৃষি নির্ভর এসএমই খাতকে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করছি। কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি ব্যাংক অঙ্গীকারবদ্ধ। কৃষি ব্যাংকের অনলাইন ব্যবস্থাও বর্তমানে অনেক শক্তিশালী। গ্রাহক চাইলে যে কোনো শাখা থেকে টাকা জমা দেওয়া কিংবা টাকা তুলতে পারছে। ১০৩৮টি শাখা রয়েছে। ব্যাংকের নিজস্ব এটিএম বুথ ছাড়াও যে কোনো ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের সুবিধা রয়েছে। ‘বাংলা-ক্যাশ’’ নামে কৃষি ব্যাংকের নিজস্ব মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম রয়েছে। এছাড়া শিগগিরিই একটি অ্যাপ চালু করতে যাচ্ছি যা গ্রাহকরা ঘরে বসে সব ধরণের লেনদেন করতে পারবে। এছাড়া বিদেশে বসেও গ্রাহকরা একাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে সব ধরনের লেনদেন করতে পারবে। নানামুখী উদ্যোগের ফলে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি খাত। বিশ্ব পরিমণ্ডলে যা উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলছে। সরকার আমাদেরকে যেভাবে নির্দশনা দিয়েছে সেভাবেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে আমাদের ব্যাংকটি। জনগণের কল্যাণে সরকারের কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক প্রায় সব কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি ব্যাংক। নতুন নতুন কৃষককে খুঁজে বের করে ৪ শতাংশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঋণসুবিধা দিচ্ছে।
সকলের সংবাদ: আপনার পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাই?
শওকত আলী খান: অনেক পরিকল্পনা রয়েছে । তার মধ্যে প্রথম পরিকল্পনা রয়েছে খেলাপি ঋণ কমানো । বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২ শতাংশ রয়েছে। যা আগামী জুনের মধ্যে ১০ শতাংশ নিয়ে আসবো। বর্তমান ব্যাংক লোকসানে রয়েছে। লোকসানি থেকে কিভাবে লাভে আনতে পারি এর একটা পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রাহকদের স্মার্ট সেবা দেয়ার জন্য যা যা করার দরকার তা করবো। নতুন গ্রাহক কিভাবে বের করে আনতে পারি তারও একটা পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটিতে মূলধন ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতি কাটাতে আমাতন সংগ্রহ করার একটা পরিকল্পনা রয়েছে। যাতে প্রবাসী গ্রাহকরা বিদেশ থেকে আসার পথে কোন প্রকার হয়রানি শিকার না হতে হয়। তাই প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সেবা চালু করতে চাই। তাদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা ও ইয়ারপোর্টে মালামাল নিরাপদে আনতে পারে সেই ব্যবস্থা করবো। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া শীর্ষ খেলাপীদের কাজ খেলাপী ঋণ আদায়, লস শাখাকে শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আনাসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে।