নিজস্ব প্রতিবেদক: বাইরের ঝামেলা এড়াতে বাসা-বাড়িতে সরঞ্জাম রেখে অনেকেই ডায়াবেটিস মাপার কাজটি সারেন। এজন্য একটি টেস্টিং স্ট্রিপ ব্যবহার করা হয়। এই স্ট্রিপ অবৈধভাবে এনে বিদেশের নামি প্রতিষ্ঠানের মোড়কে দেশের বাজারে ছাড়ছে একটি প্রতিষ্ঠান। আর এই মোড়ক প্রিন্ট করা হয় রাজধানীতেই। শুধু মোড়ক নয়, ভেতরের স্ট্রিপগুলোও দেশে তৈরি হচ্ছে কি না সেটিও কেউ জানে না। এমন ভয়াবহ প্রতারণার প্রমাণ মিলেছে ফার্মা সলিউশন নামে একটি দেশীয় কোম্পানির বিরুদ্ধে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান রবিবার দুপুরে রাজধানীতে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানান। নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বিক্রয় প্রতিরোধে আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীবৃন্দ ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় সভার এ আয়োজন করে অধিদপ্তর।
ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্রের নাম গ্লুকোমিটার। এই যন্ত্রের সাহায্যে ঘরে বসেই রক্তের সুগার (অর্থাৎ, ডায়াবেটিসের মাত্রা) কত পয়েন্ট তা মাপা যায়। এক্ষেত্রে ল্যানসেট নামে একটি সূক্ষ্ম সুঁইয়ের সাহায্যে আঙুলের ডগায় খোঁচা দেওয়া হয়। রক্ত বেরিয়ে এলে টেস্টিং স্ট্রিপে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে সেটি মেশিনে ঢুকিয়ে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়।
বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি রোশ ইন্টারন্যাশনালের ডায়াবেটিস স্ট্রিপ নকল করে বাজারজাত করা ফার্মা সলিউশন নামে দেশীয় কোম্পানী সম্পর্কে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘এই যে ডায়াবেটিস স্ট্রিপটি দেখছেন এটি বিদেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের তৈরি। অথচ এর বাইরের যে আবরণ এটি আমাদের রাজধানীর নয়াপল্টনেও প্রিন্ট হয়। এই বিষয়টি যখন বিদেশের সেই কোম্পানি জানবে তখন বাংলাদেশ সরকারের মাথা কতটা নিচু হয়ে যাবে? আরও একটা প্যাকেট পেলাম যেখানে লেখা ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। এমন তারিখ তো পৃথিবীতেই থাকার কথা নয়। নকল করতে করতে এমন অবাস্তব তারিখও আবিষ্কার করে ফেলেছেন!’
নয়াপল্টনে কীভাবে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির ডায়াবেটিস স্ট্রিপের নকল মোড়ক প্রিন্ট করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে উল্লেখ করে এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘দেশের অধিকাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি বাসায় বসে ডায়াবেটিস স্ট্রিপ দিয়ে সুগার পরিমাপ করেন। অথচ এই ডায়াবেটিস স্ট্রিপ নকল হচ্ছে। নয়াপল্টনের প্রিন্ট ওয়ান নামে একটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে নকল মোড়ক প্রিন্ট করা হয়। এই প্রিন্টিং প্রেস মূলত ফার্মা সলুশনসকে মোড়ক সরবরাহ করার পাশাপাশি বাজারজাত করতে সহায়তা করে।’
মোড়ক নকল হলেও ডায়াবেটিসের স্ট্রিপগুলো লাগেজ পার্টির মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা হয় বলে ফার্মা সলিউশন দাবি করে। এ বিষয়ে এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘ফার্মা সলিউশনের পাঁচ থেকে ছয়টি ডিপো আছে, যা থেকে সারাদেশে এই স্ট্রিপগুলো সরবরাহ করে থাকে। কিন্তু ঢাকার তেজকুনিপাড়ায় তাদের ডিপোতে গিয়ে জানলাম যে এই স্ট্রিপ তারা সরবরাহ করে না। পরে তারাই স্বীকার করেছে যে তারা এই স্ট্রিপগুলো সরবরাহ করে এবং বিদেশ থেকে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে এগুলো নিয়ে আসে।’
প্রমাণ পেয়ে ফার্মা সলিউশনকে সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জানিয়ে ভোক্তা-অধিকারের মহাপরিচালক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কতগুলো অননুমোদিত ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বাজারজাত করেছে সেই তথ্য জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় প্রিন্ট ওয়ানকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তাছাড়া কাস্টমস পয়েন্ট ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এসব পণ্য ঢুকছে সে বিষয়ে গভীরভাবে তদারকি করার পাশাপাশি ওষুধ প্রশাসনকেও অনুসন্ধান করতে বলা হয়।’
মোড়ক নকল, তবে ভেতরের ওষুধও নকল কি না— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘স্ট্রিপগুলোর মোড়ক নয়াপল্টনে প্রিন্ট হয়। সুতরাং মোড়ক দেশে তৈরি হয়, এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পেরেছি। তবে ভেতরের স্ট্রিপগুলোও দেশে তৈরি হচ্ছে কি না সে বিষয়ে আমরা অভিযানে নামব। সেজন্য ভেতরের জিনিসগুলো আসল কি না সেজন্য এর স্যাম্পল (নমুনা) আমরা টেস্টে পাঠাবো। এছাড়া নকল ব্যাচের যেসব ওষুধ ফার্মেসিতে আছে তা জব্দ ও প্রত্যাহার করা হবে। যারা এই নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বিক্রি করছেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করার পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’
ভোক্তা-অধিকারের মহাপরিচালক বলেন, ‘ব্যবসা মানেই কী আপনি একটি ভয়ংকর জিনিস জনগণের হাতে তুলে দেবেন? এই ভয়ঙ্কর ব্যবসা যারা করছেন তাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চলছে।’
সভায় ফার্মা সলিউশনের প্রধান নির্বাহী পল্লব চক্রবর্তী নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপের মোড়কের বিষয়ে দায় স্বীকার করলেও দেশে ডায়াবেটিস নিয়ে তাদের অবদানের বিষয় উত্থাপন করতে গেলে অনেকের প্রতিবাদে থামতে হয়। পল্লব চক্রবর্তী বলেন, ‘কোম্পানির কিছু বিক্রয়কর্মীর মাধ্যমে এটি ঘটেছে। বিক্রয়কর্মীদের নানা ধরনের চাপ থাকে, চাপে পড়ে তারা এটা করেছে। তবে দায় আমাদের নিতে হবে; বাড়তি বলার কিছু নাই। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক বিষয়।’
তবে নকল মোড়ক তৈরি করায় প্রিন্ট ওয়ানের স্বত্বাধিকারী লুৎফর রহমান বেশ অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ফার্মা সল্যুশনসের সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল। তাদের লেনদেন এত ভালো যে মোড়ক ছাপাতে আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। আমরা দুটি ধাপে প্যাকেট ছেপেছি—১০ থেকে ১১ হাজার টাকার প্রিন্টিং। তবে আমি দুই লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছি। এরপরও যদি আমার বা আমার পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়, আমি তা মাথা পেতে নেব। কারণ, দেশের অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে, এমন ঘটনায় সহায়তা করেছি।’
সভায় উপস্থিত অন্যরা এসব ঘটনায় দেশের অনেকের প্রাণহানি ঘটতে পারে বিধায় এই প্রতিষ্ঠানসহ অন্য কোম্পানিরও অননুমোদিত সব স্ট্রিপ বাজার থেকে তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
নকল স্ট্রিপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘অভিযানকালে শুধু নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ নয়, বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ স্ট্রিপও পাওয়া গেছে। এমনও ফার্মেসি পাওয়া গেছে, যেখানে পাঁচ মিনিট অভিযান করে ৪৩ প্যাকেট মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ এখনো ফার্মেসিতে পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যায়, এসব অভিযানের সময় ফার্মেসির মালিক বলেন, ভুলে এসব পণ্য থেকে গেছে। তারা ক্ষমা চান। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তাঁদের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। মানুষের প্রাণহানি হতে পারে জেনেও তাঁরা এসব বন্ধ করছেন না; খুবই দুঃখজনক।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, ঘটনাটি সাধারণভাবে চাল–ডালের ভেজালের সঙ্গে মেলালে চলবে না। এই পণ্য কোল্ড চেইন মেনে বাজারজাত করতে হয়। এ ধরনের পণ্য দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসতে গেলে ঋণপত্র না খোলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী আমদানির জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে কেউ বেআইনি কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।
মতবিনিময় সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক (কার্যক্রম ও গবেষণাগার বিভাগ) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন এবং বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হকসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।