নিজস্ব প্রতিবেদক: শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৪ ব্যাংক। ২০২৩ সালের পুরো সময়ে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি থেকে সোনালী, রুপালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক আদায় করেছে ১৭০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি ব্যাংক চারটির সঙ্গে বৈঠক করে শীর্ষ খেলাপি থেকে ঋণ আদায় জোরদার ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাসহ বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে, বড় গ্রাহকদের কাছে থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে ব্যাংকের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও আশানুরূপ আদায় করা সম্ভব হয়নি।
এবিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বড় ঋণ খেলাপিরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পার পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে অনেকে রাজনৈতিক প্রভাবও খাটায়। ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। এসব ঋণ আদায় করা এখন অনেকট সময় সাপেক্ষ।
তথ্য মতে, শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি থেকে ২০২৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৩০০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩৬ কোটি টাকা বা ১২ শতাংশ আদায় করতে পেরেছে। ২০২২ সালে সোনালী ব্যাংক শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় করেছিলো লক্ষ্যমাত্রার ৪ শতাংশ।
আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক ২০২৩ সালে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি থেকে আদায় করেছে ৭০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটির জন্য লক্ষ্যমাত্রা বেধে দিয়েছিলো ৩৫০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে রূপালী ব্যাংকের আদায়ের হার ছিলো লক্ষ্যমাত্রার ৩ শতাংশ।
এছাড়া আগ্রণী ব্যাংক আদায় করেছে ২০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিলো ৬৮৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছিলো লক্ষ্যমাত্রার ৩২ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে আগ্রণীর ঋণ আদায়ের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমেছে।
অপরদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণ আদায় কমেছে। ২০২৩ সালের ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে ৮৭০ কোটি টাকা আদায় করার ক্থা ছিলো। তবে ব্যাংকটি মাত্র ৪৩ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৫ শতাংশ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। ২০২২ সালে শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় করেছিলো লক্ষ্যমাত্রার ১১ শতাংশ। আলোচ্য সময়েও সোনালী ব্যাংকের খেলাপী ঋণ আদায় কমেছে।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আসহান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর সব জায়গায় সমস্যা রয়েছে। প্রথমত রাজনৈতিক দুর্বলতা রয়েছে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারের দুর্বলতায় খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিজস্ব প্রশাসনিক দুর্বলতা রয়েছে। এসব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিষ্ঠা, সততা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায় করার সক্ষমতা নেই। তারা রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত করে ঋণ দিয়ে দেয়। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার এখতিয়ার বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এসব ব্যাংকগুলোকে শুধু আমানত সংগ্রহের জন্য রাখা দরকার।
এদিকে বাংলাদেশের জন্য দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। এর একটি হলো, দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার কমানো। চলতি বছরের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে ঋণদাতা এ সংস্থাটি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনেক ঋণ তদারকির বাইরে থেকে যাচ্ছে। কারণ এসব ব্যাংকের বড় গ্রাহকের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক প্রভাবশালী। ফলে আগের ভালো ঋণগুলোও এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিলো ১৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।
একই সময়ে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে জনতার খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া মার্চ শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা।