নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকার অর্থ সংগ্রহের জন্য দেশে সর্বপ্রথম ২০২০ সালের শেষের দিকে ইসলামি বন্ড বাজারে এনেছিলো। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ও ২০২২ সালের প্রথামার্ধে আরও দুটি সুকুক বাজারে ছাড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোগুলো সরকারি এই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে পারছিলো। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজারে আর কোনো ইসলামি বন্ড আনেনি সরকার। এর ফলে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের সুযোগ কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সর্বপ্রথম সরকার ইসলামি বন্ড বাজারে ছাড়ে ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক ইস্যু করা এ সুকুক বন্ডের মাধ্যমে ৮ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। সরকার জনসাধারণকে নিরাপদ পানি সরবরাহের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যেশ্যে প্রথম ইজারাহ সুকুকের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করেছিলো।
দ্বিতীয় শরিয়াভিত্তিক ইসলামি সুকুক বন্ড বাজারে আসে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর। এর মাধ্যমে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা তুলেছিলো। যে প্রকল্পের জন্য টাকা তোলা হয়েছিলো তার নাম ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাহিদামাফিক উন্নয়ন প্রকল্প’। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছিলো প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
এরপর সরকার সর্বশেষ শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি সুকুক বন্ড ছাড়ে ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল। এ বন্ডের মাধ্যমে ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩ এর নির্মাণ ও উন্নয়ন’ এর জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা তুলেছে সরকার।
তখন বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিলো, সরকারের এই সুকুক কার্যক্রম দেশের পল্লি অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনযাত্রার সার্বিক মানোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সুকুক হল, প্রথাগত ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াই একটি দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের উৎস। বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশ পান সুকুক বিনিয়োগকারীরা। তবে এই বিনিয়োগের বিপরীতে সুদহার নির্দিষ্ট করা থাকেনা; নির্দিষ্ট এই সুদহারের বিষয়টিই ইসলামে নিষিদ্ধ। সরকার সাধারণত বাজেট ব্যয় নির্বাহে রাজস্ব আহরণ, ট্রেজারি বিল-বন্ড ইস্যু, ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শরিয়াভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলোর কাছে সুকুক বন্ডের ১২ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বা ৭১ দশমিক ৬৪ শতাংশ রয়েছে। প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী শাখা এবং উইন্ডোজের হাতে রয়েছে ১ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ সুকুক। প্রচলিত ব্যাংকের হাতে রয়েছে ২ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ১১ শতাংশ সুকুক। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে সুকুকের ২১ কোটি টাকা রয়েছে।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে সুকুক বন্ড চালু হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের পরিসর বেড়েছিলো। গত অর্থবছরে নতুন করে কোনো সুকুক বাজারে না আসার ফলে এসব ব্যাংকের বিনিয়োগের যায়গা কিছুটা সংকুচিত হয়েছে। তবে সামনের দিনগুলোতে আরও নতুন নতুন প্রোডাক্ট বাজারে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে সুকুক ইস্যুর ব্যাপারে বেশ আগে থেকে পরামর্শ দিতে থাকে। তারই অংশ হিসেবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এডিবির শর্ত ছিল ২০১৭ সালের মধ্যে বিএসইসিকে ‘সুকুক বন্ড’ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। সেই শর্তের আলোকে বাংলাদেশের তারল্য ব্যবস্থাপনা, বাজেট ঘাটতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের টেকসই বিকল্প হিসেবে সুকুক ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর যা বাস্তবে রুপ নেয় ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সরকারের রাজস্ব আহরণ আশানুরুপ না হওয়ায় সুকুকের মাধ্যমে অর্থ তুলেছিলো সরকার। দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের জন্য এটি একটি ভালো পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বড় বড় প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। অপরদিকে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর জন্যও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করে।
বিশ্বব্যাপি ইসলামি বন্ড বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম প্রচলিত বন্ডের বিকল্প হিসেবে করপোরেট সুকুক ইস্যু হয় ১৯৯০ সালে। ২০০১ সালে বাহরাইন সরকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে ইজারাভিক্তিক সুকুক বাজারে ছাড়ে। ২০০৩ সালে কাতার ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সুকুক ইস্যু করে। ২০০৪ সালে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ‘সুকুক আল-ইস্তিসনা’ নামে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সুকুক ইস্যু করে। একই বছর দুবাই ইসলামি ব্যাংক ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সুকুক ইস্যু করে।
এরপর ধারবাহিকভাবে ২০০৫ সালে ইন্দোনেশীয় সরকার, ২০০৬ সালে আমেরিকার ইস্ট ক্যামেরন পার্টনার্স, ২০০৯ সালে সিঙ্গাপুর সরকার, ২০১১ সালে রাশিয়ার তাতারিস্তানের রাজধানী কাজানে এবং ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যে সুকুক ইস্যু করা হয়। একই বছর হংকংয়ে ইজারা সুকুক চালু হয়।
সরকারের পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতও সুকুক ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। দেশের পুঁজিবাজারে সুকুক বন্ড ছেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিলো বেক্সিমকো লিমিটেড।