অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক: উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে টাকার সরবরাহ কমানোর পাশাপাশি নীতি সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এলক্ষ্যে নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে।
নতুন সিদ্ধান্ত মতে নীতি সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশ করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অন্যান্য ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের দিকে হাঁটছে।
অর্থ সরবরাহ কমিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল এমন লক্ষ্য নিয়ে চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। মুদ্রানীতির সার্বিক বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। এবারের মুদ্রানীতিতে ৪টি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিং পলিসি করা হয়েছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে এই মুদ্রানীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমলে অসুবিধা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গভর্নও আরও বলেন, সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সময়ের প্রয়োজন। এটা নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সময় লেগে যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে নেওয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও, আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়নি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ। নভেম্বরে এই মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৭৬ শতাংশ। গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৬ শতাংশ, যা গত প্রায় ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি লক্ষমাত্র ধরা ছিলো ৮ শতাংশ।
তিনি বলেন, আগের চেয়ে মূল্যস্ফীতি না বাড়লেও গত নভেম্বর থেকে ক্রমাগত কমছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকারে রেখে এবারও মুদ্রানীতি প্রণয়ন হয়েছে। এবারের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হার চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবারের মুদ্রানীতিতে বিশেষ রেপো সুদহারে (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি-এসএলএফ) নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করেছে। বর্তমানে এটি ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চার শতাংশের ব্যাংক রেটে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি বা এসডিএফ) নিম্নসীমার সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়।
নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফের (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৯.৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯.৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে সংকটে পড়া ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে কিছুটা ব্যয় কমবে।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (ডিসেম্বর পর্যন্ত) জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১০.৯ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির মতো ঋণ প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। আর গত নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৯.৯০ শতাংশ, যা লক্ষ্যের চেয়ে ১ শতাংশ কম।
জানুয়ারি-জুন সময়ের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। একই সময়ের জন্য সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ; সরকারি খাতে ছিল ১৮ শতাংশ।
পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সংকট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত কারণে তারল্য সংকট হয়েছে। তাদের সুকুক বন্ড রয়েছে টোটাল ইসলামী ব্যাংকের দুই শতাংশ। অন্য ব্যাংকগুলোও তারল্য সংকট ছিল তবে তাদের বন্ডে বিনিয়োগ থাকায় টাকা সরবরাহ করা গেছে।
আর্থিক খাতের দুর্বলতার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আগেই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করেছিলাম। এটা বলতে পারি দুর্বল ব্যাংকগুলো আর খারাপের দিকে যায়নি। দেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, হবেও না। তবে ওই দুর্বল ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। তারা খারাপের দিকে যায়নি আর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবে।
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, আবু ফরাহ মো. নাছের ও নুরুন নাহার, নির্বাহী পরিচালক খোরশেদ আলম, মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রমুখ।
সকল বিভাগের সংবাদ
রবিবার, ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি, সকাল ৬:৫৭