নিজস্ব প্রতিবেদক: দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে আরও কঠোর হয়ে সুশাসন নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
দেশ থেকে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ, ঋণ-কর-বিল খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং অবৈধ অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্তের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এই ইশতেহার তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হল দুর্নীতি। কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
“আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা হবে ।”
দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান, গত ১৫ বছরের অর্জন এবং আগামী দিনের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ধরে সাজানো হয়েছে তাদের ৯৮ পৃষ্ঠার ইশতেহারে।
এবার দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মত ১১টি বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
দুর্নীতি প্রতিরোধে ক্ষমতাসীন সরকারের নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, “দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের টোল ফ্রি নম্বর ১০৬-এর মাধ্যমে জনগণ যেকোনো স্থান থেকে বিনা খরচে জানতে পারছে। আমাদের অঙ্গীকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতি মোকাবিলায় কার্যকর পন্থা ও উপায় নির্বাচনপূর্বক তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
“দুর্নীতি দমন কমিশনের চাহিদা মোতাবেক বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধের নিমিত্তে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণয়ন, নাগরিক সনদ রচনা, তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন এবং অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।”
অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, “জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য ও দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ চলমান থাকবে। প্রশাসনে দুর্নীতি নিরোধের জন্য ভূমি প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, আদালত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সকল ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ করা হবে।
“শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য পাঠ্যক্রমে দুর্নীতির কুফল ও দুর্নীতি রোধে করণীয় বিষয়ে অধ্যায় সংযোজন করা হবে।”
গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অবকাঠামো ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন প্রশংসা পেলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে খেলাপি হওয়া ঋণের কারণে সমালোচনাও পেতে হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির হিসাবে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ১৯টি ব্যাংকে ২৪টি বড় ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ৯২ হাজার কোটিরও বেশি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।
ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো নিয়ে ১৫ বছরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই হিসাব দিয়েছে সংস্থাটি।
সিপিডি বলছে, ২০০৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায়।
বিপুল পরিমাণ এ অর্থ আদায়ে আরও কঠোর হওয়ার অঙ্গীকার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং এক্ষেত্রে ব্যাংক যাতে বিধি নির্ধারিত সঞ্চিতি রাখে তা নিশ্চিত করা হবে। মুদ্রা সরবরাহ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নীতি সুদ হার ব্যবহারকে ‘প্রধান উপায়-উপকরণ’ হিসাবে প্রয়োগ করা হবে।”
টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানোর অঙ্গীকার করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিতে আমরা সদা তৎপর। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি কার্যকর সংসদই পারে কেবল জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে। আমরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা আরও সুদৃঢ় করব।
“আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সপক্ষে আওয়ামী লীগ ‘সবসময়ই সোচ্চার’। সামাজিক বৈষম্য নিরসন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাঙ্ক্ষিত শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। যেখানে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিশ্চিত হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা এবং কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।”
জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার সবসময়ই তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর, উন্নত, মানবিক ও জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে কাজ করেছে।
“ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্মার্ট ও আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলা হবে।”
দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাস
দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য হ্রাসে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে দারিদ্র্যের হার ১১ শতাংশে, চরম দারিদ্র্যের অবসান এবং ২০৪১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনব।”
‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ এর আওতায় গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, “গ্রামের যুবসমাজের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমাতে গ্রামেই আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কর্মক্ষম, যোগ্য তরুণ ও যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ, জেলা ও উপজেলায় ৩১ লাখ যুবকের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সহায়তা প্রদান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।”
কৃষি ক্ষেত্রে ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, “ব্যবহারযোগ্য কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য করা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত থাকবে। বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো-টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে।
“কৃষির আধুনিকায়ন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ অব্যাহত থাকবে।”
এবার টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের জন্য ভোটের লড়াইয়ে নামার অনেক আগেই নির্বাচনি স্লোগান ঠিক করে ফেলে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা এখন দেশবাসীকে দেখাচ্ছেন ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও ইশতেহার প্রণয়ন উপ কমিটির আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুস রাজ্জাক ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।