বিশেষ প্রতিনিধি: খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য সারাদেশে অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন আছে গত মার্চ মাস পর্যন্ত দেশের ৬০টি ব্যাংকের মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ৫৯৩টি। এতে আটকা পড়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ৫৮৪টি, এর বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। ফলে চলতি বছরের তিন মাসে মামলার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৯টি। আর জড়িত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ১০ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন বিভাগের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গত বুধবার ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। সভায় খেলাপি ঋণের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে ঋণ আদায় কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
মূলত আগের মামলা নিষ্পত্তিতে গতি কমে যাওয়া ও নতুন মামলা দায়ের বাড়ায় মামলার স্তূপ কমছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বের করা ঋণ স্বাভাবিক নিয়মে আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বারবার সুবিধা ও ছাড় দেওয়ার পরও এসব ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না খেলাপিরা। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে এসব ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা হলেও নিষ্পত্তি হচ্ছে খুবই কম। ব্যাংকাররা বলছেন, প্রয়োজনের তুলনায় অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম হওয়া ও বিচারকের অভাব এবং আইনি মতামতের জন্য ব্যাংকের আইনজীবীকে পর্যাপ্ত সময় ও সহায়ক জামানতের পর্যাপ্ত দলিলাদি সরবরাহ করতে না পারায় অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতাসহ বিভিন্ন কারণে অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি দেখা যায়। অনেক সময় বিচারক ছুটিতে থাকেন বা ট্রান্সফার হয়ে যান। এ ছাড়া অভিজ্ঞ আইনজীবীরও অভাব রয়েছে। আরেকটা সমস্যা হলো, মামলা হলেই তার বিপরীতে রিট করে স্থগিতাদেশ নেন ঋণখেলাপিরা।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২০-২০২৪-এর আইন বিভাগ সংশ্লিষ্ট অবজেকটিভ ৯.৪ (বি)-এর অ্যাকশন প্লান-জি অংশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলাধীন খেলাপি ঋণ নজরদারির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশলগত পরিকল্পনার ওই লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ হ্রাসের লক্ষ্যে মামলাধীন ঋণগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আইন বিভাগ থেকে নিয়মিত তদারকি করার সিদ্ধান্ত হয়।
সে অনুযায়ী এ সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইন বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত নির্দেশনা, পরামর্শ ও বিবিধ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণের মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করে নিয়মিত ব্যাংকার্স সভায় উপস্থাপন করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন বিভাগ।
এ বিষয়ে গতকাল উপস্থাপিত প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে অর্থঋণ আদালতে মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৭ হাজার ৭০৩টি। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় হয়েছে ১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। সেখানে ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ৮ হাজার ৩৬৯টি। এর বিপরীতে আদায় হয়েছিল ১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরের তিন মাসে মামলা নিষ্পত্তি ও আদায়ের পরিমাণ কমে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বছরের ব্যবধানে কমেছে। গত বছরের মার্চে অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৮২১টি। এর বিপরীতে আটকে ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। এই হিসাবে গত এক বছরের ব্যবধানে মামলার সংখ্যা কমেছে প্রায় ৭ হাজার ২২৮টি। তবে মামলার সংখ্যা কমলেও জড়িত অর্থের পরিমাণ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ২৯ হাজার ১২৮ কোটি টাকা।
সম্প্রতি খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর লিগ্যাল টিম শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নির্দেশনায় লিগ্যাল টিমে কর্মকর্তা ও প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ এবং তাদের বার্ষিক মূল্যায়ন কীভাবে করতে হবে, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে গত মাসে জারি করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, সামগ্রিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় আদায় কার্যক্রম সুসংহত করার ক্ষেত্রে ব্যাংকের আইন বিভাগ বা লিগ্যাল টিমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান খেলাপি ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অর্থ ঋণ আদালতে মামলাধীন।
অনেক খেলাপিঋণের বিপরীতে ঋণগ্রহীতা সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন। যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ব্যাংকের লিগ্যাল টিমকে আরও শক্তিশালী করা হলে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে। ফলে একদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের হবে, অন্যদিকে ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
এ ছাড়া আদালতের বাইরেও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতির আওতায় খেলাপি ঋণ আদায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে এডিআর পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে পাওনা আদায়ের নোটিশেই মধ্যস্থতার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তকরণ, দ্রুত পাওনা আদায়ের সম্ভাবনা থাকলে কেস টু কেস ভিত্তিতে কিছুটা ছাড় দেওয়াসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।