নিজস্ব প্রতিবেদক: এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হারে মেয়েরা ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছে ছেলেরা। অন্তত ২০১৮ সাল থেকে গত সাত বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পাসের হার ও সর্বোচ্চ স্কোর ‘জিপিএ-৫’ (গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ) প্রাপ্তিতে ছেলেরা কেন পিছিয়ে রয়েছে সেই বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলো কোনো গবেষণা করেনি। এবার সেই বিষয়ে গবেষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল রোববার (১২ মে) প্রকাশ হয়েছে। এতে ৯টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন। এর মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন। গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।
উত্তীর্ণদের মধ্যে ছাত্র আট লাখ ছয় হাজার ৫৫৩ জন এবং ছাত্রী আট লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ জন। ছাত্রীদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ছাত্রদের পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। পাসের হারে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা দুই দশমিক ৯ শতাংশ এগিয়ে। আর এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী।
গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার দুই দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে। গত বছর এ পরীক্ষায় এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। সেই হিসাবে এবার জিপিএ-৫ এক হাজার ৪৪৯ জন কম পেয়েছে।
এবার মোট জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরর মধ্যে মেয়ে ৯৮ হাজার ৭৭৬ এবং ছেলে ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন। সেই হিসাবে ১৫ হাজার ৪২৩ জন মেয়ে বেশি জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার সংবাদকে বলেছেন, ‘ফলাফলে পাসের হার ও জিপিএ প্রাপ্তিতে ছাত্রীরা কেন এগিয়ে- সেই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোনো গবেষণা বা স্টাডি করা হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন; এবার গবেষণার উদ্যোগ নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।’
তিনি বলেন, তাদের ধারণা-ছাত্রদের মধ্যে ‘বইবহিঃভূর্ত’ কর্মকা-, ‘কিশোর গ্যাংয়ে’ সম্পৃক্ত হওয়া, কৃষি কাজে জড়ানোসহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি।
কিন্তু ছাত্রীদের মধ্যে এই ধরণের কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত বা জড়িত হওয়ার প্রবণতা খুব একটা নেই জানিয়ে তপন কুমার সরকার বলেন, ‘ছাত্রীদের একটি বিশেষ সুবিধা হলো-তারা উপবৃত্তি পাচ্ছে; যে সুবিধা ছাত্রদের তেমন নেই।’
প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফলাফলের অনুলিপি তুলে দেয়ার পর দুপুরে নিজ মন্ত্রণালয়ে প্রেস কনফারেন্সে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছেলেরা সংখ্যায় কম কেন, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ছেলেদের সংখ্যা কমার কথা নয়, (মেয়েদের) সমান হওয়া উচিত।’
সাত বছরের চিত্র
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, অন্তত গত সাত বছরে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় গড় পাসের হারে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছে। তবে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় কোনো বছর ছাত্রদের সংখ্যা বেশি ছিল; আবার কোনো বছর ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি ছিল।
২০১৮ সালের এই পরীক্ষায় ছাত্রদের পাসের হার ৭৬ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ছাত্রীদের পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। পরের বছর ছাত্রদের তুলনায় দুই দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি ছিল ছাত্রীদের পাসের হার।
পরবর্তীতে ২০২০ সালে ছাত্রদের পাসের হার ছিল ৮১ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং ছাত্রীদের পাসের হার ছিল ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
২০২১ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ছাত্রদের পাসের হার ছিল ৯২ দশমিক ৬৯ শতাংশ; আর ছাত্রীদের তা ছিল ৯৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
২০২২ সালের এই পরীক্ষায় ছাত্রদের পাসের হার ছিল ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং ছাত্রীদের এই হার ছিল ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ।
গত বছর এই পরীক্ষায় ছাত্রদের পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ছাত্রীদের এই হার ছিল ৮১ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
বোর্ডওয়ারি পাসের হার
এ বছর পাসের হারে এগিয়ে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৯২ দশমিক ৩২ শতাংশ। এরপরই রয়েছে রাজশাহী বোর্ড, যেখানে পাসের হার ৮৯ দশমিক তিন শতাংশ। পাসের হারে তৃতীয় অবস্থানে বরিশাল বোর্ড, যেখানে পাসের হার ৮৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
ঢাকা বোর্ডে এবার পাসের হার ৮৩ দশমিক ৯২ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮২ দশমিক আট শতাংশ, কুমিল্লায় ৭৯ দশমিক দুই শতাংশ, দিনাজপুরে ৭৮ দশমিক চার শতাংশ ও ময়মনসিংহে ৮৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে।
পাসের হারে গত বছরের মতো এবারও পিছিয়ে সিলেট শিক্ষা বোর্ড। সিলেটে এবার পাসের হার ৭৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।
জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতেও এগিয়ে ছাত্রীরা
শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়ে ৯৮ হাজার ৭৭৬ এবং ছেলে ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন। সেই হিসাবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে ১৫ হাজার ৪২৩ জন।
এবার সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা। এ বোর্ডে এবার ৪৯ হাজার ১৯০ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর মধ্যে ছেলে ২২ হাজার ৩৭৪ জন এবং মেয়ে ২৬ হাজার ৮১৬ জন।
অন্যান্য বোর্ডের মধ্যে বরিশালে জিপিএ-৫ পেয়েছে ছয় হাজার ১৪৫ জন। তাদের মধ্যে ছেলে দুই হাজার ৬৩০ এবং মেয়ে তিন হাজার ৫১৫ জন।
চট্টগ্রামে জিপিএ-৫ পেয়েছে দশ হাজার ৮২৩ জন। তাদের মধ্যে ছাত্র পাঁচ হাজার ৭৩ এবং ছাত্রী পাঁচ হাজার ৭৫০ জন।
কুমিল্লা বোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ হাজার ১০০ জন। তাদের মধ্যে ছেলে পাঁচ হাজার ২৬৪ জন ও মেয়ে ছয় হাজার ৮৩৬ জন। সিলেট বোর্ডে জিপিএ পেয়েছে পাঁচ হাজার ৪৭১ জন, যাদের মধ্যে ছেলে দুই হাজার ৬১৬ এবং মেয়ে দুই হাজার ৮৫৫ জন।
এছাড়া দিনাজপুর বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৮ হাজার ১০৫ জন, ময়মনসিংহে ১৩ হাজার ১৯৭ জন, রাজশাহীতে ২৮ হাজার ৭৪ জন, যশোরে ২০ হাজার ৭৬০ জন, মাদ্রাসা বোর্ডে ১৪ হাজার ২০৬ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে চার হাজার ৮১ জন।
শতভাগ পাস ও শূন্য পাস প্রতিষ্ঠান
সারাদেশের দুই হাজার ৯৬৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৫৪টি। সেই হিসাবে এবার শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে ৬১৪টি।
অন্যদিকে শূন্য পাস অর্থাৎ একজনও পাস করেনি-এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবার বেড়েছে। গত বছর শূন্য পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ৪৮টি। এ বছর ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন পরীক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি।
এবার শূন্য পাস করা ৫১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪২টি মাদ্রাসা রয়েছে। এছাড়া দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে চারটি, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে তিনটি ও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বিদেশি পরীক্ষা কেন্দ্রে পাস ২৯৮ শিক্ষার্থী
দেশের বাইরের ৮টি কেন্দ্রে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় ৩৪৭ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ২৯৮ জন। অকৃতকার্য হয়েছে ৪৯ জন। গড় পাসের হার ৮৫ শতাংশ ৮৮ শতাংশ। দুটি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ সব পরীক্ষার্থী পাস করেছে।
কাম্য শিক্ষার্থী না থাকলে সুযোগ-সুবিধা বন্ধের হুঁশিয়ারী শিক্ষামন্ত্রীর
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কাম্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ধরে রাখতে না পারলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখা যাবে না বলে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘নিবন্ধিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে আলিয়া মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর বাইরে যে অনেকগুলো অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে অনেক শিক্ষার্থী চলে যাচ্ছে। এ বিষয়ে তাদের মনোযোগী হতে হবে। ব্যয় বাড়ার কারণে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থী চলে যাচ্ছে কিনা, সেটিও দেখতে হবে।’
পাসের হার বেশি হওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, করোনার পর এবারই প্রথম যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারা শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের জায়গায় সম্পূর্ণভাবে সেটা সম্পন্ন করতে পেরেছে। সে কারণেও পাসের হার বেড়ে হতে পারে। এ বছর পরীক্ষার্থী সংখ্যাও কিছু কম, সেজন্যও হয়তো শতাংশের হিসাবে পাসের হারটা বেড়ে থাকতে পারে।
শূন্য পাস করা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী অনেক প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে। সেজন্য শূন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।? সেগুলোতে কেন্দ্র থাকা উচিত কিনা সেটি আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া, সেটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। সেখানে এমপিও বন্ধ করে দিলে আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
খাতা চ্যালেঞ্জ সোমবার (১৩ মে) থেকেই
ফলাফলে সন্তুষ্ট না হওয়া শিক্ষার্থীরা প্রতিবারের মত এবারও খাতা চ্যালেঞ্জ বা ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদনের সুযোগ পাচ্ছে।
সোমবার থেকে ১৯ মে পর্যন্ত এসএমএসের মাধ্যমে ফল পুনঃনিরীক্ষাণের আবেদন করা যাবে। এ জন্য আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিটি বিষয় ও পত্রের জন্য ১৫০ টাকা।
রোববার ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আবুল বাশার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।