অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, বিশ্বের সকল দেশেই ব্যাংক একীভূত করার ইতিহাস আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে একীভূত করার ঊদ্যোগ নিয়েছে এটা ভাল। তবে তড়িগড়ি করে একীভূত করা ঠিক হবে না।
আজ বৃহস্পতিবার ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফে সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মৃধা। অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন ইআরএফে সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘ব্যাংকএকীভূত করতে হলে দুই ব্যাংকের সম্মতি থাকা দরকার। এছাড়া ব্যাংক একীভূত করার আগে সেই ব্যাংকগুলোর হিসাব-নিকাশ শেষ করতে হবে। তারপর একীভূত করার উদ্যোগ নিতে হবে। হিসাব-নিকাশ না করে একীভূত ঘোষনা করা ঠিক হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকে পরিণত করার একমাত্র পথ মার্জার নয়, আরও পথ আছে। বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে মার্কেটে দিচ্ছে। এ কারণেই মূল্যস্ফীতি কমছে না।’
তিনি বলেন, ‘একীভূত হওয়ার জন্য যে পাঁচটি ব্যাংকের নাম শোনা যাচ্ছে তার মধ্যে তিনটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তারমধ্যে আছে বেসিক ও বিডিবিএল এবং রাকাব। এই ব্যাংকগুলো দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিলে ভাল করবে। এদের সুনাম রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই মুহুর্তে অর্থপাচার ঠেকানো দরকার। প্রতিবছর ৭০০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে। এদের নাম প্রকাশ করা হোক। সরকার কেন এদের নাম প্রকাশ করছেনা। তা বুঝতে পারছিনা। অর্থপাচারকারীই হচ্ছে দেশের বড় শত্রু। ’
তিনি আরও বলেন, ‘বড় বড় ঋণ খেলাপিদের বিভিন্ন সময় সুদ মওকুফ করা হচ্ছে। এটা কেন করা হচ্ছে তা বুঝতে পারছিনা। এটা করা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। সুদ মওকুফ করার কারণে এরা আরও সুযোগ খুজে কিভাবে খেলাপি হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, পৃথিবীর সব দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তেমনভাবে পারেনি। এ জন্য মনিটরিং পদ্ধতি বদল করতে হবে, সরাসরি তদারকি বাড়াতে হবে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, ৯ দশমিক ৭ মূল্যস্ফীতির পরও মানুষ ভালো আছেন বলে মন্ত্রীরা বলছেন। এটা বাস্তবতা বিবর্জিত। হয়তো সামান্য বেতন বেড়েছে কিন্তু এই মূল্যস্ফীতিতে মানুষ ভালো আছে এটা বলা যাবে না।
সাবেক গভর্ণর ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ আমাদের দরকার না। আর্থিকখাতে সুশাসন ফিরিতে আনতে আইএমএফকে প্রয়োজন । এদের দিয়ে আর্থিক খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে।’
তিনি বলেন, আমাদের দেশের ঋণ খেলাপি, কর খেলাপি এবং অর্থপাচার একই সূত্রে গাথা। ঋণ পুনঃতফসিল করার কারণে ব্যাংকে অর্থের টান পড়েছে। এর জন্য বন্ডের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে অর্থ সরবরাহ করতে হচ্ছে। যার ফলে মূল্যস্ফিতি কমছে না। তাই শক্ত হাতে খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে। এই বিষয়গুলো নীতি নির্ধারকদের বোঝানোর মত একটা লোক প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, দেশের সবাই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে। কিন্তু কেউ অনেক বেশি আবার কেউ একেবারেই কম। আগের তুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অবক্ষয় হয়েছে সেটার সাথে আমি একমত। কেন যেন অর্থ পাচারের ব্যাপারে সরকার এবং ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) নিরব। কিন্তু এটা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকগুলোতে স্বল্পমেয়াদী আমানতের পরিমাণ বেশি। এ খাত থেকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দিলে সমস্যা তৈরি হয়। এজন্য দেশের পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করার দরকার ছিলো। তবে দেশের পুঁজিবাজার শক্তিশালী হয়নি।
দেশের ঋণ খেলাপিদের বিষয়ে তিনি বলেন, খেলাপি ওয়ালারা যদি অনেক বড় হয়ে যায় তাহলে সমস্যা। ১০ হাজার টাকার কৃষি ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে তাকে জেলে ঢোকাবো, কিন্তু ১০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হলে তাকে সালাম ঠুকবো এটা হতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ঋণগুলো অবশ্যই আদায় করা উচিত।
ফরাসউদ্দিন বলেন, ধনী গরিবের বৈষম্য আগেও ছিল এখনো রয়েছে। তবে ধনী ও গরিবের মধ্যে অর্থের পার্থক্য আগের তুলনায় বেড়েছে। এই বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থনীতি নয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ এর প্রয়োজন।
দেশের ব্যাংকিং খাতের সার্বিক সমস্যার সমাধানে ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করারও প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।