নিজস্ব প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারে চলছে অভাবনীয় দুঃসময়। লভ্যাংশ ঘোষণার মৌসুমেও নিষ্প্রাণ পড়ে আছে এ খাতের খাতের শেয়ার। বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই বিনিয়োগকারীদের। পড়ে আছে লেনদেনের তলানীতে। মূল্যবৃদ্ধির পরিবর্তে নিয়মিত শেয়ারের দর হারাচ্ছে বেশিরভাগ ব্যাংক। এর মধ্যে বাজারে লেগেছে মার্জার বা একাধিক ব্যাংকের একীভূত হওয়ার ঢেও। ব্যাংকারদের মতো বিনিয়োগকারীরাও বিভ্রান্ত, উদ্বিগ্ন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আজ (১৮ মার্চ) লেনদেন হওয়া ৩৬টি ব্যাংকের মধ্যে ২৩টির শেয়ারের দামই কমেছে। বিপরীতে মাত্র ৫টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেড়েছে। আর অপরিবর্তিত ছিলো ৮টি ব্যাংকের শেয়ারদর।
এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের শেয়ারের দাম গত কিছুদিন ধরে টানা কমছে। ইতোমধ্যে ১১টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে। আরও কয়েকটির শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের একেবারে কাছাকাছি।
গত বছর পর্যন্ত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময়কে ব্যাংকের শেয়ারের জন্য সুসময় হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। তার কারণ ব্যাংকের লভ্যাংশ ঘোষণা। দেশে সকল ব্যাংকের হিসাববছর হচ্ছে, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর। বেশিরভাগ ব্যাংক ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে তাদের লভ্যাংশ ঘোষণা করে থাকে। এই লভ্যাংশকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ে এই খাতের শেয়ারে। তাতে বাজারে ব্যাংক খাতের শেয়ারের লেনদেন ও দাম-দুটোই বেশ বেড়ে যায়। আর তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে সামগ্রিক বাজারে। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ দেখা যাচ্ছে এই খাতের শেয়ারে।
বিশ্লেষকদের মতে, বেশ কিছু কারণে এবার লভ্যাংশের মৌসুমেও ব্যাংক খাতের শেয়ারের তেমন নড়াচড়া নেই। প্রথমত: সামগ্রিক বাজারেই পতনমুখী প্রবণতা (Bearish Trend) চলছে। ব্যাংকিং খাতের শেয়ারেও এর প্রভাব পড়েছে। দ্বিতীয়তঃ ব্যাংকিং খাতের লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু কড়াকড়ি আরোপ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে আগাম অনুমোদন নিয়ে ব্যাংকগুলোকে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে হয়। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কতটুকু লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু সন্দেহ আছে। এর মধ্যে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে ব্যাংকিং খাতে মার্জারের বিষয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাল ব্যাংকের সাথে মন্দ ব্যাংকের একীভূতকরণের বিষয়ে একরকম জিহাদের ঘোষণা দিয়েছে। ভাল ব্যাংকগুলো তুলনামূলক দূর্বল ব্যাংককে একীভূতকরণে বাধ্য হলে তাদের (ভাল ব্যাংক) পারফরম্যান্সও খারাপ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা সাপেক্ষে এই খাতের শেয়ারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে।
এদিকে মার্জার নিয়ে সব মহলেই কিছু অস্পষ্টতা, কিছু উদ্বেগ রয়েছে। ব্যাংক মার্জারের বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ অর্থসূচককে বলেন, এখানে অনেকগুলো প্রশ্নেই অজানা। যদি পদ্মা ব্যাংকের নেট অ্যাসেট ভ্যালু নেগেটিভ হয় তাহলে এই দায় কে পূরণ করবে? খেলাপি ঋণের কী হবে? বাংলাদেশে এখনও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নেই। যদি এমন কোনো কোম্পানি দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ কিনে নেয়, তাহলে কত দামে কিনবে, বাকি অর্থের দায়ই-বা কে বহন করবে? কবে নাগাদ এই বেচাকেনা হবে?’ সব মিলিয়ে, পুরো বিষয়টিই এখনও অস্পষ্ট বলেও মনে করছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এক্সিম ব্যাংকের সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখা। এরপর কোনো ত্রুটি পেলে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে জানানো দরকার।
এর আগে গত রোববার একীভূতকরণ সংক্রান্ত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করেছে এক্সিম ব্যাংক। এর ফলে একীভূত হওয়ার খবর পুঁজিবাজারের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পেরেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
গতকাল রোববার পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকায় এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের মনোভাব বোঝা যায়নি। আজ লেনদেন শুরু হওয়ার পর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ।
তথ্য মতে, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস সোমবার (১৮ মার্চ) এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারের বড়দর পতন হয়েছে। শেয়ার মূল্য ৩০ পয়সা কমে ফেসভ্যালু ১০ টাকার নিচে নেমে গেছে। আজই এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের মধ্যে একীভূতকরণ নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসইতে আজ লেনদেনে অংশ নেওয়া ৩৯৬টি কোম্পানির মধ্যে ৩৩০টি কোম্পানির শেয়ারদর কমেছে। এর মধ্যে দরপতনের শীর্ষে উঠে এসেছে গোল্ডেন সন লিমিটেড। গোল্ডেন সনের ইউনিটদর আগের কার্যদিবসের তুলনায় কমেছে ২ টাকা ১০ পয়সা বা ৯ দশমিক ০৫ শতাংশ। তাতে দরপতনের শীর্ষে জায়গা নিয়েছে কোম্পানিটি।
বাংলাদেশে এর আগেও বেশ কিছু ব্যাংক একীভূত হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই সরকারি ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক আছে একটি। সেসব ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও বেশি ভালো না।
আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, দেশের কোন ব্যাংক এখনও দেউলিয়া হয়নি। ব্যাংকের পর্যায়ে কাজ শেষ হলে আদালত এবং বিএসইসির কিছু কাজ আছে। এসব প্রক্রিয়া শেষ হলে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে ঘোষণা দেওয়া হবে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠান এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ (এক্সিম)। শরীআহ্ ভিত্তিক এ ব্যাংকটি বেসরকারি পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য সাক্ষরিত করেছে আজ। তবে তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকটি একিভূত হতে হলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমতি লাগবে।