নিজস্ব প্রতিবেদক: শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা মামলায় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে ঘোষিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। আদালতের নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দাখিল করতে হবে। তবে, চলতি মাসের শেষদিকে এ মামলায় আপিল আবেদন করবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রায়ের বিষয়ে আপিল আবেদন করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করবে বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। ওইদিনই রায়ের অনুলিপি হাতে পেয়েছি। তবে অনেক দেরি করে রায়ের অনুলিপি আমাকে দেওয়া হয়েছে।
রায়ে ড. ইউনূসকে সাজা দেওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়। তবে, পূর্ণাঙ্গ রায় সন্তুষ্ট করতে পারেননি ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। তিনি বলেন, ন্যায়বিচার খণ্ডিত করে দিয়েছেন বিচারক।
ড. ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার কর্মকর্তাকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় বছরের প্রথম দিনই ৬ মাসের জেল দেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত। শর্ত ছিল এক মাসের মধ্যে আপিল করবেন তিনি। ৮৬ পাতার সেই রায় প্রকাশ হয় বৃহস্পতিবার।
রায়ে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করাসহ অন্যান্য অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তবে পুরো রায় পড়ে ড. ইউনূসের আইনজীবী বলেন, ন্যায়বিচারকে খণ্ডিত করেছেন বিচারক। যদিও এর সঙ্গে একমত নন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।
ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বাদী বলেছেন এ ধরনের কোনো দাবি মামলার আর্জিতে করা হয়নি। অথচ ড. ইউনূসকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে তাকে অর্থদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। এতে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।
কলকারাখানা অধিদপ্তরের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, এটি শ্রম আদালতের যুগান্তকারী রায়, যা ভবিষ্যতে নজির হয়ে থাকবে। ড. ইউনূসের আপিল করার সুযোগ আছে। তিনি তা করবেন। তবে আমরা সেটার বিরোধিতা করবো।
রায়ে ড. ইউনূসকে ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এ সিদ্ধান্তও আইনের বাইরে গিয়ে নিয়েছেন বিচারক। ড. ইউনূসের আপিলের আইনগত সময় ৬০ দিন। অথচ তাকে ৩০ দিনের জামিন দিয়েছেন বিচারক। এসময়ের মধ্যে আপিল করতে বলা হয়েছে, যা আইনে নেই।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, ড. ইউনূসের আপিলের সময়সীমা ৬০ দিন। কিন্তু তাকে ৩০ দিনের জামিন দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে আপত্তি থাকলে সেদিন তিনি বলেননি কেন?
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, জানুয়ারির শেষেই তারা শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করবেন। তিনি বলেন, আমরা এটা পর্যবেক্ষণ করবো। পরে আপিল প্রস্তুত করবো। এক্ষেত্রে সময় লাগবে। তবে দ্রুত সেটা করার চেষ্টা করছি আমরা।
এর আগে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা মামলায় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। রায়ে গ্রামীণ টেলিকমের সব শ্রমিককে তাদের ন্যায্য পাওনা ৩০ দিনের মধ্যে দিতে বলা হয়েছে।
শ্রম আইনের ৩০৩ (ঙ) ধারায় সর্বোচ্চ ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১০ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যদিকে ৩০৭ ধারায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন আদালত।
চলতি বছরের শুরুর দিন সোমবার (১ জানুয়ারি) রায়ের জন্য ধার্য দিনে ঢাকার শ্রম আদালত-৩ এর বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। এরপর আসামিপক্ষ আপিলের শর্তে জামিন আবেদন করেন। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে পাঁচ হাজার টাকা বন্ডে এক মাসের জন্য জামিন দেন।
এই সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে যেসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তা বিধি সংশোধন করে সেসব সুবিধা প্রদান করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু হয়। রায় শোনার জন্য ১টা ৪০ মিনিটে আদালতে উপস্থিত হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বেলা ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে তিনি আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন।
এদিন রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আদালত চত্বর ও আশপাশে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ। খবর সংগ্রহের জন্য ভিড় জমান দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা।
ড. ইউনূসের পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও রায় শুনতে বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকারকর্মীরা আদালতে উপস্থিত হন। আদালতের এজলাস কক্ষ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
এদিকে রায় ঘোষণার পর ড. ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, তারা ন্যায়বিচার পাননি। এ বিষয়ে ক্লায়েন্টেদের সঙ্গে কথা বলে আপিলের সিদ্ধান্ত নেবেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, আসামিরা শ্রম আইন না মেনে নিজস্ব আইনে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত করেছিলেন এজন্যে তারা শস্তি পেয়েছেন। রায় ঘোষণার পর আসামিদের আপিলের শর্তে জামিনও মঞ্জুর করেছেন আদালত।
২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
এ মামলায় ড. ইউনূস ছাড়াও গ্রামীণ টেলিকমের এমডি মো. আশরাফুল হাসান, পরিচালক নূরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহানকে বিবাদী করা হয়।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, শ্রম আইন, ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হলেও তাদের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি দেওয়া, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া হয় না।
মামলায় আরও অভিযোগ আনা হয়, গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি এবং লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেওয়া হয় না।