নিজস্ব প্রতিবেদক: এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জনের বেশি প্রার্থীর ১০০ কোটির বেশি সম্পদ রয়েছে। বছরে এক কোটিরও বেশি আয় করেন ১৬৪ জন। স্বতন্ত্র ও দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ৪৮০ জন।
মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ।
নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। তথ্যচিত্র তুলে ধরেন তিন সদস্যের গবেষণা দলের প্রধান তৌহিদুল ইসলাম। অন্য দুই সদস্য হলেন- রিফাত রহমান ও রফিকুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল ও সুমাইয়া খায়ের।
টিআইবি জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থীর সংখ্যা ১৮৯৬ জন। যার মধ্যে ১৮ শতাংশ স্বতন্ত্র আর ৮২ শতাংশ প্রার্থী দলীয়। ৯৪ দশমিক ৯০ শতাংশ পুরুষ আর নারী প্রার্থী ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।
কোন দলে কত কোটিপতি- নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের মূল পেশা ব্যবসা। আর বাৎসরিক আয় ১ কোটি টাকার বেশি এমন প্রার্থীর সংখ্যা ১৬৪ জন। ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ১৮ জন। স্বতন্ত্র ও দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা ৪৮০ জন।
এছাড়াও ১০ কোটি টাকার বেশি আছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। ৫০ কোটি টাকার বেশি আছে ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। এক কোটি টাকাও নেই এমন প্রার্থী ৭২ দশমিক ০৯ শতাংশ।
কোটিপতি প্রার্থীর মধ্যে ২৩৫ জন আওয়ামী লীগের, ১৬৩ জন স্বতন্ত্র, ৪৭ জন জাপা, ১৭ জন জেপি, ৭ জন জাসদ, ৬ জন তৃণমূল বিএনপি, ৫ জন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির।
আয়ের শীর্ষে ১০ মন্ত্রী- গত পাঁচ বছরের আয়ের শীর্ষে রয়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তার আয় হয়েছে ২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তার আয় বেড়েছে ২৭৫ শতাংশ, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের আয় বেড়েছে ২২৮ শতাংশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমানের আয় বেড়েছে ২২৭ শতাংশ, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের আয় বেড়েছে ১৬৪ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের আয় বেড়েছে ১৪৮ শতাংশ, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর আয় বেড়েছে ১২২ শতাংশ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আয় বেড়েছে ১১৯ শতাংশ এবং খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের আয় বেড়েছে ৯১ শতাংশ।
শীর্ষ ২০ শতকোটি প্রার্থী– নির্বাচনী হলফনামায় একশ কোটি টাকা বেশি আছে এমন প্রার্থীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তার সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে বাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এ কে একরামুজ্জামান। তার সম্পদ ৪২১ কোটি টাকা। সালমান এফ রহমানের সম্পদ ৩১৫ কোটি টাকা। কুমিল্লা-৮ আসনের এমপি আবু জাফর মোহাম্মদ শফি উদ্দিনের সম্পদ ৩০৬ কোটি, কুমিল্লা-৩ আসনের এমপি আবু ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের ২৭৭ কোটি, চুয়াডাঙ্গা-১ স্বতন্ত্র প্রার্থী দিলীয় কুমার আগর ওয়ালার ২৭৬ কোটি, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের এমপি আব্দুল মমিন মন্ডলের ২৫৩ কোটি টাকা, নারায়ণগঞ্জ-১ স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী গোলাম মুর্তজার ২৩৩ কোটি, নংসিংদী-৩ স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ১৭৪ কোটি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও ঢাকা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাঈদ খোকনের ১৬৩ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী বেড়েছে- দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রধান বিরোধী শক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় ‘ডামি প্রার্থী’ হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন করছেন। গত চারটি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে টিআইবি দেখেছে, এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩৪৭ প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন। এর আগে যথাক্রমে ২০১৮ সালে ১৩৪ জন, ২০১৪ সালে ১০৫ এবং ২০০৮ সালে ১৪০ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।
ব্যবসায়ী ৫৭ শতাংশ- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের মূল পেশা ব্যবসা। এরপর রয়েছে আইনজীবী ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। কৃষিজীবী ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। চাকরিজীবী ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। শিক্ষক ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। রাজনীতি মাঠে রাজনীতিবিদদের থাকার কথা থাকলেও পেশা হিসেবে রাজনীতি দেখিয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ, চিকিৎসক ২ দশমিক ১৯ শতাংশ।
স্বশিক্ষিত প্রার্থী ১৩.৬৬ শতাংশ- নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, দ্বাদশ নির্বাচনে মোট প্রার্থীর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রার্থীর ফরমাল কোনো শিক্ষার সনদ নেই অর্থাৎ তারা স্বশিক্ষিত প্রার্থী। এরপর ৫৭ শতাংশ প্রার্থী স্নাতক ও স্নাতককোত্তর ডিগ্রিধারী। সবচেয়ে বেশি প্রার্থী স্নাতক। এই অংশ ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্নাতক। এ স্তরের প্রার্থীর সংখ্যা ২৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে ১১ শতাংশ, মাধ্যমিক ৯ শতাংশ প্রার্থী।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া আয়-সম্পদ ও ঋণ-দায় বিবরণী কতটা সঠিক এবং আয় ও সম্পদ কতটা বৈধ উপায়ে অর্জিত তা যাচাই করা হয় না। আবার সম্পদের অর্জনকালীন যে মূল্য হলফনামায় দেখানো হয়েছে তা নিয়েও বড় রকমের প্রশ্ন রয়েছে।
হলফনামায় প্রার্থীরা নিজেদের অর্জিত সম্পদ কতটা দেখিয়েছেন? পুরোটা দেখিয়েছে কি না? কিংবা দেশে বা বিদেশে সম্পদ ধারণের তথ্য গোপন করেছেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
টিআইবির প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী, সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে, যার প্রতিফলন হলফনামায় নেই। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন কোম্পানি এখনও বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল স্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যেসব কোম্পানির মোট সম্পদ মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার বেশি।