নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকগুলোর যে ঋণ একাধারে দুই বছর মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত রয়েছে, সেসব ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে। এই ঋণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া অবলোপন করা যাবে না।
রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে ঋণ/বিনিয়োগ অবলোপন এবং তা আদায় কার্যক্রম জোরদারে ইউনিট গঠন ও এর কার্যাবলী সংক্রান্ত নীতিমালার বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে অনাদায়ি ঋণ হিসাবগুলোকে বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী বিরূপ মানে শ্রেণিকরণপূর্বক এর বিপরীতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ি এরূপ ঋণ হিসাবগুলোকে স্থিতিপত্রে প্রদর্শন করতে হয় বিধায় ব্যাংকের স্থিতিপত্রের আকার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে ওইসব মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত ঋণ অবলোপন করা হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পদ্ধতি।
অবলোপনযোগ্য ঋণ স্থিতির বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় বিধায় ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায়ও কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। তবে অবলোপনকৃত ঋণের ওপর যেহেতু ব্যাংকের অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে, তাই তা আদায় কার্যক্রমে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা আবশ্যক। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ঘোষিত কর্মকৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসরণ করে অনাদায়ি ঋণ হিসাব অবলোপন এবং অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে নীতিমালা সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
নির্দেশনাগুলো হলো:
যেসব ঋণ হিসাব একাধারে দুই বছর মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত রয়েছে, সেসব ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে। ঋণের শেণিমান যাই হোক না কেন, কোনো মৃত ব্যক্তির নিজ নামে অথবা তার একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত ঋণ হিসাব ব্যাংক স্বীয় বিবেচনায় অবলোপন করতে পারবে। তবে, একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির উপার্জনক্ষম উত্তরসূরি রয়েছে কি না তা বিবেচনায় নিতে হবে।
ঋণ হিসাব অবলোপন পদ্ধতি
অবলোপনযোগ্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের অনুকূলে বন্ধকিকৃত সম্পত্তি (যদি থাকে) নিয়মানুসারে বিক্রয়ের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলে এবং ব্যাংকে নিশ্চয়তা প্রদানকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায়ে সমর্থ না হলে উক্ত ঋণ অবলোপনের আওতায় আসবে। অবলোপনের জন্য নির্বাচিত ঋণ হিসাবগুলোর ক্ষেত্রে আগে আইনগত ব্যবস্থা শুরু না হয়ে থাকলে অবলোপনের পূর্বে অবশ্যই অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ অনুযায়ী মামলা দায়ের করতে হবে।
তবে অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর আওতায় অত্যাবশকীয়ভাবে মামলাযোগ্য না হলে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ এবং মৃত ব্যক্তির নিজ নামে অথবা তার একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত যে কোনো অঙ্কের ঋণ মামলা দায়ের ব্যতিরেকে অবলোপন করা যাবে। অবলোপনের আগে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবের স্থিতি হতে শুধুমাত্র রক্ষিত স্থগিত সুদ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট ঋণস্থিতির সমপরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে অবলোপনের জন্য চিহ্নিত প্রতিটি ঋণ হিসাবের বিপরীতে রক্ষিত প্রভিশন পর্যাপ্ত না হলে ব্যাংকের চলতি বছরের আয় খাত বিকলন করে অবশিষ্ট প্রভিশন সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব রিপোর্টিং পদ্ধতি
কোনো ঋণ হিসাব আংশিকভাবে অবলোপন করা যাবে না। পরিচালনা পর্ষদের (বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তে স্থানীয় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের) অনুমোদন ব্যতিরেকে কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে না।
অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ও তদারকি
ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ২৮(ক) ধারা অনুযায়ী অবলোপনের পরও সংশ্লিষ্ট ঋণের ওপর ব্যাংকের দাবি বহাল থাকবে। অবলোপন পরবর্তী সময়ে উক্ত অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে আইনগত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রধান কার্যালয়ে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ (ইসলামি শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ‘অবলোপনকৃত বিনিয়োগ আদায় ইউনিট’) নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দুই ধাপ নিচে নন এরূপ একজন কর্মকর্তাকে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিটের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। এই ইউনিটে ঋণ মঞ্জুরি কার্যক্রম, ঋণের ডকুমেন্টেশন ও ঋণ আদায়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বহাল করতে হবে। তবে, ন্যূনতম একজন আইন বিষয়ে ডিগ্রিধারী কর্মকর্তাকে এ ইউনিটে বহাল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে শাখা/বিভাগের অবলোপন করা ঋণ আদায়ের কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে, ওই শাখা বা বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন উপযুক্ত কর্মকর্তাকে আদায় কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ বা পুনর্নিয়োগকালে ওই পদের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট টার্ম অব রেফারেন্স এ অবলোপনকৃত ঋণ আদায় সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সক্ষমতা বা বাৎসরিক আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তার এই পদে পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্ম উৎকর্ষতার অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
অবলোপনকৃত ঋণ আদায় অগ্রগতির বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সভাপতিত্বে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট কর্তৃক মাসিক ভিত্তিতে সভা আয়োজন করতে হবে। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো কার্যবিবরণী আকারে রাখতে হবে।
অবলোপনকৃত ঋণ আদায় সম্পর্কিত অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রতি ত্রৈমাসিকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করতে হবে। ব্যাংকের পাওনা আদায়ে দায়েরকৃত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দক্ষ এবং খেলাপি ঋণ আদায় সংক্রান্ত মামলা পরিচালনায় অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগসহ অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যাংকের আইন বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাসহ লিগ্যাল রিটেইনারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করবেন।
এ সার্কুলার জারির ১৫ দিনের মধ্যে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট গঠনপূর্বক বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। ইউনিট গঠনের পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা এই ইউনিটে বহাল রাখতে হবে।
অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে আদায়কৃত অর্থের পাঁচ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ প্রণোদনা হিসেবে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণযোগ্য হবে। বিতরণযোগ্য অর্থের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রাপ্য হবেন। অবশিষ্ট অর্থ অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিটের প্রধানসহ ওই ইউনিটের অন্যান্য কর্মকর্তারা পাবেন।
ভবিষ্যতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কার্যকর হলে ব্যাংকের স্বার্থ সংরক্ষণপূর্বক অবলোপনকৃত ঋণ বিক্রি করা যাবে। সেক্ষেত্রে বিক্রয়ের বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর করতে হবে।
অবলোপনকৃত ঋণের হিসাব একটি পৃথক লেজারে সংরক্ষণ করতে হবে এবং ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০২৩ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ৩৮ ধারায় বর্ণিত তফসিলের ‘আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতির নির্দেশনা’ অনুযায়ী রিপোর্ট করতে হবে। ঋণ অবলোপন করা হলেও সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা তার ঋণের দায় পরিশোধ না করা পর্যন্ত যথানিয়মে খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) বিএলডব্লিউ হিসেবে যথারীতি রিপোর্ট করতে হবে। ঋণ অবলোপন সংক্রান্ত তথ্য সংক্রান্ত ২০১২ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করতে হবে।
অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে চলতি দ্বায়িত্বে কর্মরত কর্মকর্তার প্রতিস্বাক্ষরে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রতি তিন মাসে অন্তর পরবর্তী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে দাখিল করতে হবে।
ব্যাংকের পরিচালক বা পরিচালক থাকাকালীন ঐ ব্যক্তির নিজের বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত ঋণ সাধারণভাবে অবলোপন করা যাবে না। তবে,এই ধরনের গ্রাহকের মৃত্যুসহ অন্যান্য কারণে কোনো ঋণ হিসাব অবলোপনের আবশ্যকতা দেখা দিলে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ কর্তৃক নিরীক্ষা করে অবলোপনের প্রকৃত কারণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
ইসলামি শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকগুলো এই নীতিমালা অনুসরণ করে তাদের বিনিয়োগ হিসাব অবলোপন করতে পারবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর হবে।