সম্প্রতি গ্যালারি কায়ায় অনুষ্ঠিত হলো শিল্পী সোহাগ পারভেজের ‘মাই কান্ট্রি’ শিরোনামের প্রদর্শনী। এটি পুরোটাই প্রকৃতিনির্ভর চিত্র প্রদর্শনী। আদ্যোপান্ত নদীমাতৃক এই দেশ প্রকৃতির নানা রূপ, রস, সৌন্দর্য, ভাব, লাবণ্যে পরিপূর্ণ। সোহাগের তুলিতে সেসব গুণকে স্বছন্দে প্রবিষ্ট করা হয়েছে।
শিল্পের কোনো নির্দিষ্ট চৌহদ্দি নেই। প্রতিটি শিল্পী স্বতন্ত্র বলেই তাই তো প্রত্যেক শিল্পকর্মও আলাদা চেহারা নিয়ে জন্মায়। মূলত শিল্প হচ্ছে শিল্পীর প্রতিমূর্তি। শিল্পী স্বছন্দে নিজেকেই আঁকেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আর্টের মধ্যে মানুষ নিজেকেই প্রকাশ করে।’ শিল্পী সোহাগ পারভেজের ছবিতেও তার চরিত্রায়ণ রয়েছে। যেমন দর্শন, আদর্শ, মেধা, মনন এবং শিল্পযাপন—সবটুকুই তাঁর ছবিতে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর ছবির যাত্রাপথ চেনা থাকলেও গন্তব্য অচেনা। তাঁর তুলিগুলো প্রবল বেগে ছুটে বেড়ায় দিগ্বিদিক।
সোহাগ তাঁর চিত্র পরিসরে রং ও তুলিকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রাখেন। দেখেন তুলি ও রং গড়িয়ে–ছড়িয়ে কী রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে তাঁর কালার প্যালেটের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলে মনে হবে, নানাবিধ রঙের রঙিন প্লাবন শুরু হয়েছে। সবকিছুর সমন্বয়ে সৃষ্টির উদ্যান নির্মাণ করেন তিনি।
সেই তুলিগুলো অজস্র আঁচড়সমেত গন্তব্যহীন রওনা দিয়ে আরও নতুন অচেনা গন্তব্যের সন্ধান পায়। তাঁর ছবির গায়ে অজস্র কাটাছেঁড়া টোন, ডট, লাইন সর্বদা বিরাজমান। তাঁর চিত্রপটে আঁকার সময় শুরুতে অনেক সময় ছবির দেখা মেলে না, কেননা ছবিগুলো পুরো জমিনে লুকিয়ে থাকে বা হারিয়ে যায়। আবার কীভাবে যেন সোহাগ প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো সেই সব ছবি খনন করে উদ্ধার করেন। তিনি শিরোনামের মাথায় রেখে ছবি আঁকেন না। পৃথিবীতে এমন বহু বিখ্যাত সিনেমা রয়েছে, যেখানে ছবির নাম নির্বাচন না করেই শুটিং শুরু করেছে এবং শেষও করেছে। তেমনি সোহাগ পারভেজও আঁকতে আঁকতে শিরোনামের দিকে পৌঁছান। বা বলা চলে, ছবি নিজেই তার শিরোনাম অর্জন করে।
সোহাগ তাঁর চিত্র পরিসরে রং ও তুলিকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে রাখেন। দেখেন তুলি ও রং গড়িয়ে ছড়িয়ে কী রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে তাঁর কালার প্যালেটের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলে মনে হবে নানাবিধ রঙের রঙিন প্লাবন শুরু হয়েছে। সবকিছুর সমন্বয়ে সৃষ্টির উদ্যান নির্মাণ করেন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলতে হয়, সোহাগকে আমি কাছ থেকে দেখেছি, দেখেছি কীভাবে তিনি শিল্প সৃষ্টি করেন। ছাত্রজীবন থেকেই বনবাদাড়, গ্রামগঞ্জ, শহরে প্রচুর আউটডোরে ছবি আঁকতেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আউটডোরে গিয়ে প্রকৃতির কোনো একটি অংশবিশেষকে তিনি সরাসরি প্রকৃতি থেকে কেটে-ছেঁটে নিয়ে এসে ক্যানভাসে বসিয়ে দিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়; আউটডোরে গিয়ে আগের কোনো ছবির খোঁজ তিনি করেন না—এমনকি প্রকৃতির কাছে গিয়ে করজোড়ে আত্মসমর্পণও করেন না, তাঁর কৌশল অন্য রকম—বাস্তবের অনুধ্যান ও কল্পলোকের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সোহাগ পারভেজের ছবি। এ দুটি ভাব-উপাদানকে গুলিয়ে নিয়ে নিজস্ব শিল্পশৈলী নির্মাণেই তাঁর নিবিষ্টতা পরিদৃষ্ট হয়।
পাশ্চাত্য শিল্পীরা দৃশ্যমান প্রকৃতির খুঁটিনাটি রংতুলির মধ্য দিয়ে বিম্বিত করেন চিত্রপরিসরে, পক্ষান্তরে শান্তিনিকেতনের শিল্পরীতি পাশ্চাত্যের শিল্পরীতির অন্য পিঠ। যেমন নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর, রমেন্দ্রনাথ প্রমুখ শিল্পীর মূল ধ্যানই ছিল আউটডোরে গিয়ে বাইরের আলো–হাওয়ার সঙ্গে নিজেদের আত্মার সংযোগ স্থাপন করা। হুবহু প্রকৃতি দেখে আঁকতে হবে এমন নয়; বরং দৃশ্যমান প্রকৃতির আত্মাকে স্পর্শ করতে পারাটাই শিল্প নির্মাণের মুখ্য শক্তি। সোহাগও সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন।
সোহাগের ছবি বরাবরই আউটলাইননির্ভর। তিনি তাঁর ছবির বিষয়বস্তু ছবির ফর্ম বা গড়নকে সব সময় বহিঃরেখা দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন। পাশ্চাত্য বস্তুবাদী চিত্র যেমন আলোছায়ানির্ভর, তেমনি চীন, জাপান, ভারতবর্ষের ছবি আউটলাইননির্ভর। এটি হচ্ছে বস্তুবাদীর বিপরীত মেরু—ভাববাদী ধারা। সেই ভাববাদী শব্দটির শরীর মুখ্যত বহিঃরেখা বা সীমারেখা দ্বারা সুরক্ষিত। যদিও এসব প্রাচীন ভাবধারা এখন সব ধরনের কাজ পৃথিবীর সব জায়গায় চলছে।
সোহাগের এই প্রদর্শনীতে মোট ৪২টি শিল্পকর্ম রয়েছে। এখানে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন জলরং, অ্যাক্রিলিক, কালি ও কলম এবং চারকোল। চিত্রের বিষয় হিসেবে হাজির করিয়েছেন সাঁওতাল পরিবার, বুড়িগঙ্গা, ঝিল ও বাংলার প্রকৃতি ইত্যাদি।