নিজস্ব প্রতিবেদক: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীদের বিশেষ সভায় দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়লেন পার্টির নেতারা। নেতারা তাদের বক্তব্যে নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি এবং বেহাল দশার জন্য কাদের-চুন্নুকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছেন।
দলের চেয়ারম্যান-মহাসচিবের বিরুদ্ধে টাকা খেয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও তৃণমূল প্রার্থীদের মাথা বিক্রির অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগ তুলেছেন নির্বাচনি ফান্ড তছরুপের। ভবিষ্যতে নির্বাচনে এলে দলীয় নেতাদের মাথা বিক্রি না করতে আহ্বানও জানিয়েছেন তারা।
আজ রোরবার রাজধানীর কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় জাপার পরাজিত প্রার্থীসহ বিক্ষুব্ধ নেতারা বক্তব্য রাখেন। সভায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৩০ জন প্রার্থী বক্তব্য দেন এবং এতে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ১২২ জন প্রার্থী।
নির্বাচনে ভরাডুবি, দলীয় ও নির্বাচনি ফান্ড কুক্ষিগত করে রাখা, শেরিফা কাদেরের আসনের বিনিময়ে সিনিয়র নেতাদের বাদ দেওয়া, নির্বাচনে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও তৃণমূল নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ করে আসছেন। তাদের ধারাবাহিকতায় প্রার্থীদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। চিঠি ও প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই কর্মসূচি ভেস্তে দিতে দলীয় চেয়ারম্যান ও মহাসচিব চেষ্টা করলেও প্রার্থী ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে দুপুরের মধ্যে কাকরাইলের সভাস্থল ভরে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত হন। সভাপতিত্ব করেন দলের কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৪ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা।
উপস্থিত ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন, প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহানগর উত্তর সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু, সাবেক এমপি ইয়াহইয়া চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, আমানত হোসেন খান, যুগ্ম মহাসচিব আমির উদ্দিন আহমেদ ডালু, ফখরুল আহসান শাহজাদা, আব্দুল হামিদ খান ভাসানি, সৈয়দ ইফতেখার আহসান, সাহিন আরা চৌধুরী রিমা, সুজন দে, শাহনাজ পারভিন প্রমুখ।
তৃণমূল প্রার্থীদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের আব্দুল বাতেন, সিরাজগঞ্জ-৫ এর ফজলুল হক নুরু, নোয়াখালী-৩ এর ফজলে এলাহী সোহাগ, সিলেট-২ এর ইয়াহহিয়া চৌধুরী, সিরাজগঞ্জ-৬ এর মোক্তার হোসেন, সিরাজগঞ্জ-১ এর জহিরুল ইসলাম, গাজীপুর-৪ এর শামসুদ্দিন খান, ভৈরবের নুরুল কাদের সোহেলসহ আরও অনেকে।
বক্তব্যে নেতারা অভিযোগ করে বলেন— জিএম কাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন, অথচ ওনার দলেই কোনো গণতন্ত্র নেই। উনি দলটিকে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন। বড় বড় সভা-সমাবেশ যে নেতাগুলো নিজেদের অর্থ ও জনবল দিয়ে সফল করে একমাত্র শেরিফা কাদেরের জন্য সেই বাবলা, সেন্টু ও খোকাকে রাজনৈতিক বলি দেওয়া হয়েছে। বলি দেওয়া হয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদ কাজী ফিরোজ রশিদ এবং সিনিয়র নেত্রী সালমা ইসলামকে। সভায় জাপার শীর্ষ নেতাদের ভুল পথে নেওয়ার জন্য দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকেও দায়ী করেন অনেক বক্তা।
বক্তারা বলেন, নির্বাচন এলে আমাদের মাথা বিক্রি করেন। আর মাথা বিক্রি করবেন না। সংসার, দোকানপাট বিক্রি করে নির্বাচন করেছি, নিঃস্ব হয়ে গেছি। বলতে কান্না আসছে, কী বলবো! নৌকা, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হামলার মুখেও নির্বাচনি মাঠে ছিলাম। কথা দিয়েও আমাদের একটা টাকা দিলেন না। চেয়ারম্যান-মহাসচিব একটিবার ফোন ধরলেন না। আপনাদের সহযোগিতা তো চাইনি, কিন্তু আমাদের জন্য যে টাকা আসলো সেটা কোথায় গেল, আপনাদের জবাব দিতে হবে।
সভায় সিরাজগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে গিয়ে আমার ওপর হামলা হলো, কর্মীদের ওপর আক্রমণ হলো। চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে অভিযোগ জানাতে ফোন দিলে তারা কল ধরেননি। আর্থিক সহযোগিতা না করলেও আমাদের তো অন্তত সাহস দিতে পারতেন। আমাকে আজকের মিটিং এ আসতে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমি এসেছি দুঃখ কষ্টের কথা বলতে। আমাকে বহিষ্কার করবেন, করেন। আগে বাবলা, খোকাদের করেন।’
তিনি অভিযোগ করেন, আগেও দুই লাখ টাকার বিনিময়ে আলীগের প্রার্থীকে এনে লাঙ্গল দেওয়া হয়। মনোনয়ন বাণিজ্য করলেন। দলকে এভাবে শেষ করে দেবেন না।
সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের প্রার্থী মোক্তার হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে দল থেকে বলা হলো নির্বাচন করো। তুমি কিছু খরচ করো, আর বাকিটা দল দিবে। সে মোতাবেক আমি দোকান বিক্রি করে প্রথম কয়েকদিন প্রচারণা চালিয়েছি। পরে জিএম কাদের ও চুন্নুকে কল দিলে তারা আর রিসিভ করেননি। পরে ঢাকায় এসে দেখা করতে চাইলাম, তাও মানা করে দিয়েছে। কারণ, তাদের ভিতর ভয়, তারা যে টাকা আত্মসাৎ করেছে— কী জবাব দিবে?
পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা-৭ আসনের প্রার্থী হাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন বলেন, ‘জিএম কাদেরকে আমি স্বচ্ছ ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জানতাম। এর আগেও তিনি যখন দলের মাঝে বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন তখনও আমি বলেছিলাম, কেউ আপনার পাশে না থাকলেও আমি থাকবো। আজকে জিএম কাদের যদি নির্বাচনে না যেতো তাহলে জাতির কাছে তিনি হিরো হতেন। আমাদের হতো আগামীর বাংলাদেশ। আমরা চাই না দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। আমি যাই বলেছি, দলের পক্ষে বলেছি। আজকে হয়ত আমাকে, কাজী ফিরোজ, বাবলাকে বহিষ্কার করতে পারবেন, সে ক্ষমতা আপনার (জিএম কাদের) আছে। কিন্তু আরেকটি মিলন, কাজী ফিরোজ বা বাবলা জন্ম দিতে পারবেন না।’
নোয়াখালী-৩ আসনের প্রার্থী ফজলে এলাহি সোহাগ বলেন, ‘আপনি (জিএম কাদের) তৃণমূলের সভায় আল্লাহর ভয় দেখিয়ে বললেন বেঈমান হবো না। তৃণমূল যা চায় সে মোতাবেক আমি সিদ্ধান্ত নেবো। অথচ, সেদিন ৫৯ জনের মধ্যে ৫৭ জনই নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বললেন। আপনি কথা রাখেননি। আমরা জাতির সাথে বেঈমানি করেছি। আমাদের নেতারা লোভী অথবা আপনি লোভী। চুন্নু সাহেব কৌশলের কথা বলেছেন। কিসের কৌশল? পুরো দলকে ধ্বংস করার কৌশল? প্রার্থীদের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার কৌশল? আপনি (জিএম কাদের) চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ছিলেন এক, চেয়ারম্যান হওয়ার পর হয়েছেন আরেক। অনেক পরিবর্তন আপনার মধ্যে। প্রেসিডিয়াম সদস্য কেরানির মতো ফাইল নিয়ে আপনার পেছনে ঘুরেন। তিনি দলের প্রেসিডিয়াম কী করে হয়।’
চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে উদ্দেশ্য করে সাবেক এমপি ও সিলেটের প্রার্থী ইয়াহয়া চৌধুরী বলেন, ‘আপনি গণতন্ত্র শিখিয়েছেন, আপনার মধ্যে গণতন্ত্র নেই। আপনি স্ত্রীর জন্য ফিরোজ, বাবলা, খোকা, পীর ফজলু, আতিক, ভাসানিসহ নয়টি সিট কোরবানি দিয়েছেন। সমাঝোতার আসনের জন্য চেয়ারম্যান নিজের স্ত্রী, নাতি আর মেয়ের ভাসুরের জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছেন।’
সিলেট-২ আসনের এই প্রার্থী আরও বলেন, ‘আপনার স্ত্রী শুধু আপনাকে রান্না করে ভাত খাওয়ান, দলে তার কী অবদান বলেন। আমাদের টাকা আপনারা ভাগ বাটোয়ারা করেছেন। আপনাদের জবাব দিতে হবে।’
ভৈরবের নুরুল কাদের সোহেল বলেন, আমরা সব কিছু দিয়ে নির্বাচন করেছি। একটু খবর নেয়নি, দশটা টাকা দেয়নি। আর কত মাথা বিক্রি করবেন। নির্বাচন আসলে আর মাথা বিক্রি করবেন না।
সভায় জাপার কেন্দ্রীয় সদস্য সাহিন আরা চৌধুরী রিমা বলেন, ‘শেরিফা কাদেরের কী অবদান আছে জাতীয় পার্টিতে! তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করতে হবে এমপি বানাতে হবে! শুধুমাত্র শেরিফা কাদেরের জন্য পার্টির বরেণ্য ব্যক্তিদের জবাই করেছেন জিএম কাদের।’
সভায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, ‘নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিলো টাকাওয়ালা। আপনারা ২৬ জন সমাঝোতা করেছেন। সিটও পেয়েছেন, অর্থও পেয়েছেন। ১৭ তারিখের আগে যখন দেখলেন নিজের বউয়ের আসন কনফার্ম নয়, তখন বললেন নির্বাচনে যাবো কি না ঠিক নেই। যেই নিজ স্ত্রীর সমাঝোতার মনোনয়ন কনফার্ম তখন বললেন নির্বাচনে যাবো। শুধুমাত্র নিজ স্ত্রীর জন্য পার্টি হেভিওয়েট নেতাদের রাজনৈতিকভাবে জবাই করলেন জিএম কাদের। একটু বুকও কাঁপলো না আপনার! আপনি জিএম কাদের বললেন, ভিক্ষার সিট নিবো না, ভিক্ষাতো ঠিকই নিলেন। সারাদেশে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তারা প্রত্যেকেই এলাকায় সম্মানিত। কাউকে সম্মান না করেন, অসম্মান করার অধিকার আপনাদের নেই। আপনাদের ভেলকিবাজি নেতাকর্মীরা বুঝে গেছে। আপনি ঘুঘু দেখেছেন, ঘুঘুর ফাঁদ দেখেননি। খোদার কসম খেয়ে বলছি, ফাঁদ দেখতে চাইলে আমি দেখাবো। আজকে যদি আঘাতপ্রাপ্ত ও সকল বহিস্কৃতরা এক হয়ে যায়, তাহলে আপনার (জিএম কাদের) টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’