রমজান আলী : বছরজুড়ে দেশের ব্যাংক খাতে ছিল তীব্র ডলার সংকট। খোলাবাজারে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে ডলারের দর ওঠে ১৩০ টাকায়। এই সংকট শুধু ব্যাংকিং খাতকেই নয়, ভুগিয়েছে গোটা অর্থনীতিতে। বছরের শুরু থেকেই কমতে থাকে রিজার্ভ, উদ্বেগ তৈরি করে রেমিটেন্স প্রবাহ। কোন মাসে কমে, আবার কোন মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণে হয় নতুন রেকর্ড। বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে বেশকিছু ব্যাংক। এতকিছুর মধ্যেও কিছুটা আশা জাগায় শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া। সারাবছরই আলোচনায় ছিল আইএমএফের ঋণ। নানান নাটকীয়তার পরে এরইমধ্যে ঋণের দুই কিস্তি দিয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি এডিবির ঋণে কিছুটা বেড়েছে রিজার্ভ। এছাড়া ‘স্মার্ট পদ্ধতিতে’ সুদহার, একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক তিনজনে নামিয়ে আনাসহ কয়েকটি ভালো পদক্ষেপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
এছাড়াও ২০২৩ সাল জুড়ে আলোচনায় ছিলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ। নানান নাটকীয়তার পরে এরই মধ্যে ঋণের দুই কিস্তি দিয়েছে আইএমএফ। বছরের শেষ মাসে দাতা সংস্থাটির ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বহুল আলোচিত মোট ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪০ কোটি ডলার ঋণের ওপর ভর করে দেশের রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। এই দুই সংস্থার ঋণ পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে। তবে খরচ করার মতো রিজার্ভ (বিপিএম৬) আছে ২০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার।
ডলারের চাহিদা মেটাতে পুরো বছর হিমশিম খেতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে। চাপ সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ধারবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করেছে। এর ফলে নিট রিজার্ভ কমে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ঘরে নেমেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বছরটির শেষ দিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ আইএমএফ’র শর্ত পূরণ করতে রিজার্ভ বাড়ানোর একটি উপায় ছিলো ডলার ক্রয় করা। এর ফলে বছর শেষে রিজার্ভ সামান্য বেড়েছে।
২০২৩ সালে প্রায় ১২ লাখ মানুষ দেশের বাহিরে কাজ করতে গেছে। তবে এবছর আশানুরুপ প্রবাসী আয় দেশে আনা সম্ভব হয়নি। বছরের জানুয়ারি- নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১ হাজার ৯৯২ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। এর আগের বছরের একই সময়ে এসেছিলো ১ হাজার ৯৫৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে।
ডলারের সংকট নিরসনে ভারতের সঙ্গে রুপিতে বিনিময় ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও এটি খুব একটা কাজে আসেনি। আবার কিছু ব্যাংক রেমিট্যান্সে চলমান আড়াই শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি নিজেরা আরও আড়াই শতাংশ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। এরপরেও বাড়াতে থাকে মার্কিন ডলারের দাম।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত মার্চের পর থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে সংকট আরও প্রকট হয়। পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন-অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এর ওপর।
এরপর দুই সংগঠনের নেতারা বিভিন্ন লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ শুরু করেন। তবে কিছু ব্যাংক ডলারের নির্ধারিত দামের চেয়ে ৫ থেকে ৬ টাকা বেশি দরে ডলার কেনাবেচা করছে বলে অভিযোগ উঠে। কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দেশের সাতটি মূলধারার ও তিনটি ইসলামী ধারার ব্যাংককে জরিমানা করেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের ব্যাংক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিভাগ হলো ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি)। এটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা ছাড়া আর কেউ এ বিভাগের কোনো বিষয় পর্যবেক্ষণ বা তথ্য পাওয়ার যোগ্য নন। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা না পারলেও এতদিন তা পারতেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান শাখা। এখন থেকে ব্যাংকগুলোর শাখা অফিসও সিআইবি তথ্য পরিদর্শন ও পরিবর্তন করতে পারবেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন একটি সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এতে ব্যাংকারদের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি শঙ্কা তৈরি হয়।
আলোচিত এই বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের রেকর্ড তৈরি হয়। চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এসময় পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা।
আইএমএফের শর্ত ও ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে ৯ শতাংশ সুদহার তুলে আগামীতে ঋণের সুদহার কত হবে তা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতিতে ঠিক করা হয়। নতুন এ পদ্ধতি চলতি বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হয়। ৯ শতাংশ ঋণ সুদহার তুলে দিয়ে ট্রেজারি বিল, বন্ডের ছয় মাসের গড় সুদহার(ওয়েটেড) বিবেচনা করে প্রতি মাসে একটি রেফারেন্স রেট নির্ধারণ করে দিবে বাংলাদেশ ব্যাংক; এর সঙ্গে সর্বোচ্চ তিন শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংক।
এদিকে ২০২৩ সালে ব্যাংকিংখাতে নৈরাজ্য ঠেকাতে একই পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক ৩ জনে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ এর সংশোধনী অনুযায়ী একটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে একই পরিবারের সর্বোচ্চ ৪ জন সদস্য বসতে পারবেন। ২০১৮ সালে আইনটিতে পরিবর্তন আনা হয়। চলতি বছরের ২১ জুন জাতীয় সংসদে পাস হওয়া নতুন আইনে বলা হয়েছে, একক পরিবারের পরিচালকের সংখ্যা ৩ জনের বেশি হতে পারবে না।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯৬ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই সূচকে ১২৭ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবের সূচকে ১ হাজার ৫৪৬ কোটি ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল।
আলোচিত ২০২৩ সালে ব্যাপক আলোচনায় এসেছে তারল্য সংকটে পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের লেনদেন সেবা বন্ধের উপক্রম হওয়ার বিষয়। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এবিষয়ে গত ২৮ নভেম্বর ব্যাংক পাঁচটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সবশেষ আলোচনায় আসে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুপারিশে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে নতুন পর্ষদও গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটিতে সুশাসন আনতে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয় বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক।