নিজস্ব প্রতিবেদক: নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে জনগণের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতা নিয়ে ততই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। হামলা-পাল্টা হামলার শিকার হচ্ছেন প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নির্বাচনি ক্যাম্প। এখনো পর্যন্ত প্রায় শতাধিক জায়গায় সংঘাতের খরব পাওয়া গেছে। নির্বাচন নিয়ে সংঘাত বাড়ায় জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও মিত্র দলগুলোর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আর যেসব জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সক্রিয় এবং নৌকার প্রার্থীরা চ্যালেঞ্জের মুখে সেসব জায়গায় ঘটছে সংঘাতের মতো ঘটনা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে হলে আগে ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু করতে হবে। তাই নির্বাচনে সহিংস ঘটনা ঘটলে ভোটাররা আস্থা হারাবেন। তখন ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত করা অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই ভোটের আগে পরিবেশ সুষ্ঠু করতে হবে। সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে শুরু হয়েছে দ্বাদশ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা। চলবে আগামী ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। নির্বাচনি প্রচারণায় লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগের মাধ্যমে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন প্রার্থী ও তাদের কর্মী, সমর্থকরা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা।
তবে, প্রচারণাকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা শুরু হয়েছে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। পক্ষে-বিপক্ষে ভোট চাওয়া ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নির্বাচনি অফিসে আগুন, বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, প্রতিপক্ষ সমর্থককে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে জখম করার মতো একাধিক ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। পেশি শক্তির এসব লড়াই নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীর বেশির ভাগই ভোটের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জানান দিচ্ছেন। তাদের প্রচারণায় ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যেই পড়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। আর এজন্য বাড়ছে সংঘাতের মতো ঘটনা। নির্বাচনে নৌকা ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা নিজেদের মতো করে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এদিকে, বিএনপি নির্বচানে না আসায় নির্বাচনি প্রচারণায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রার্থীকে সমর্থন করা নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাগযুদ্ধে নেমেছেন। ভোটের মাঠে বিএনপি না থাকলেও সংঘাত-সহিংসতা, হামলা-পাল্টা হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, মারপিট ও নির্বাচনের প্রচারণায় বাধার মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় বেশি জড়িয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর-৩ আসনের কালকিনিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপের সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের মিছিলে বোমা হামলা করে। একই আসনে গত শনিবার স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের সমর্থক ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কর্মী এসকেন্দার খাঁনকে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনাও ঘটে।
গত সোমবার শরীয়তপুর-২ আসনে নড়িয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বিপ্লরে ওপর হামলা করা হয়। জানা গেছে, নির্বাচনের জেরেই তার ওপর হামলা করা হয়েছে। নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের সমর্থক তিনি। এর আগে এ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য খালেদ শওকত আলীর নির্বাচনি প্রচারণার সময় বাধা দেওয়া হয়। এ নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগও জমা দেওয়া হয়।
মেহেরপুরে নৌকার নির্বাচনি কার্যালয়ে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। শুক্রবার সকালে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুর গ্রামে নৌকার নির্বাচনি অস্থায়ী কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন চৌধুরী নদভীর পক্ষে গণসংযোগের সময় হামলার ঘটনা ঘটে। এতে নদভীর শ্যালকসহ অন্তত ১৫ জন নেতাকর্মী আহত হন।
নওগাঁর পোরশা উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের একটি নির্বাচনি ক্যাম্প ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেকুজ্জামান তোতার কর্মীদের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার ঘাটনগর ইউনিয়নের তাঁতিপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, রাতে এলাকার উন্নয়ন নিয়ে একটি ভিডিও চিত্র দেখানো হচ্ছিল। এ সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেকুজ্জামান তোতার কর্মীরা উচ্চ শব্দে গান বাজাচ্ছিলেন। এ সময় সাউন্ড কমিয়ে গান বাজাতে বললে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরই জের ধরে গভীর রাতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীরা জানালা দিয়ে আগুন ছুড়ে মারলে এতে পুড়ে যায় পোস্টার-ব্যানার। ভাঙচুর করা হয় চেয়ার। সকালে থানা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রপ্রার্থী ফিরোজুর রহমানের (কাঁচি) পোস্টার ছিনিয়ে নেওয়ায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থক ছাত্রলীগের এক নেতাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত বুধবার রাত ১০টার দিকে এই জরিমানা করা হয়।
নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনে নৌকা ও ঈগল প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১১ জন আহত হয়েছেন। বুধবার রাতে উপজেলার ইটালী ইউনিয়নের সাতপুকুরিয়া বাজারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জুনাইদ আহমেদ ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ওই ঘটনা ঘটে। এ সময় চারটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
পাবনা-১ ও ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনে স্বতন্ত্রপ্রার্থীর সমর্থকদের মারধর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ময়মনসিংহ-৯ গুরুতর আহত মো. সাদেক হোসেন ভূঁইয়াকে প্রথমে নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে।
মৌলভীবাজার-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রধান নির্বাচনি কার্যালয়ে নৌকা সমর্থকের হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ এলাকায় জাতীয় পার্টির প্রধান নির্বাচনি কার্যালয়ে এ হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এতে ৫ জন আহত হন।
ফরিদপুর-৩ আসনে পোস্টার লাগানোর সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের সমর্থককে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। বৃহস্পতিবার ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের উমেদিয়া বাজারে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, ওমেদিয়া বাজারে এ. কে. আজাদের ঈগল প্রতীকের পোস্টার লাগানোর সময় রুহুল ও টিপুর নেতৃত্বে চার-পাঁচজন যুবক আজিজ শেখের ওপর হামলা করে। তারা সেখানে ঈগলের কোনো পোস্টার লাগানো যাবে না বলে হুমকি দেয় এবং একজনকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্রপ্রার্থী ওবায়দুর রহমানের নির্বাচনি কার্যালয় ভাঙচুর এবং চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় স্বতন্ত্রপ্রার্থীর সমর্থক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক চেয়ারম্যানের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেন, প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘন চরম পর্যায়ে গেলে তখন প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। এছাড়া, নির্বাচনি মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স নেমে গেলে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রাথীদের পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে। অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে আনসার সদস্যের পাশাপাশি পুলিশের সংখ্যা বেশি থাকে। আর গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে কিছু সংখ্যক কম থাকে। চরাঞ্চল, দুর্গম এলাকা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্বে সমস্যা হলে সেগুলোকে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নোয়াখালী-৫ আসনে নৌকার মনোনীত প্রার্থী ওবায়দুল কাদের নির্বাচনি জনসভায় অংশ নিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন, সবাইকে নিয়েম মেনে চলতে হবে। নির্বাচনের আচরণবিধি মেনে চলতে হবে। কেউ অন্যায় জুলুম করলে খবর আছে। অন্যায়কারীকে শাস্তি পেতে হবে, কারো জন্য তদবির হবে না।