নিজস্ব প্রতিবেদক: ছাত্র জনতার গণ আন্দোলনে গত ৫ আগস্টে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সপরিবারে ভারতে পালিয়েছে। একই সাথে ঢাকা দুই সিটির মেয়রের ও পতন হয়েছে। বর্তমানে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিশিষ্ট অর্থর্নীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্ব বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। বর্তমান সরকার রাজধানীসহ সাদেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী বন্ধে যৌর্থবাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালিত হচ্ছে।
তবে মশক নিধন কার্যক্রম থেমে থাকায় রাজধানীতে মশার উপদ্রব উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। বলতে গেলে রাজধানী এখন মশার নগীতে পরিনত হয়েছে। ঢাকা সিটির দুই মেয়র পালানোর পর বর্তমানে দুই জন প্রশাসক দায়িত্বে আছেন। কিন্তু নগরীতে মশা নিয়ন্ত্র আনতে হলে অবশ্যই বিশেষ অভিযান এবং কার্যকর ওষুধ প্রয়োজন। কিন্তু সে ধরনের কোন উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় হঠাৎ মশার উৎপাত অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে কিউলেক্স মশার সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। মশার এই উপদ্রবে নগরবাসীর শান্তিঘুমই নষ্ট হচ্ছে না, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগের ঝুঁকিও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। প্রতিবছর মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটির পক্ষ থেকে মোটা অংকের বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়। বাজেটে বরাদ্দকৃত কোটি কোটি টাকা ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ মশক কর্মীদের বেতন ভাতার পেছনে খরচ করা হচ্ছে। অথচ নগরীতে মশক নিধনের কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত বছর (২০২৪ সালে)রাজধানীসহ সারা দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু শনাক্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। বছরজুড়ে এই রোগে প্রাণ হারান ৫৭৫ জন। দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
অথচ মশক নিধন কার্যক্রম কখনোই খুব শক্তিশালী ছিল না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে। কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তাই এর সুফল সেভাবে পায় না নগরবাসী। প্রতি বছর মশা নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ কম।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ইতোমধ্যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন তারা। মশা নিধনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রশাসক। নগরীতে দিন-রাত বাসাবাড়িতে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। অনেক এলাকায় দিনেও বাসায় কয়েল জ্বালিয়ে বা মশারি টানিয়ে রাখতে হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ পাশ কাটিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দাবি, মশা নিধনে তারা প্রতিদিনই ওষুধ ছিটায় এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন অভিযানও অব্যাহত আছে।
সূত্রমতে, ঢাকার দুই সিটিতে ‘মশা নিধনের বিষয়ে ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব নিজাম উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘মশা নিধনের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে প্রতিনিয়ত মশা নিধনে অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন নির্বাচিত সিটি মেয়র ও কাউন্সিল নেই, তাই দুই প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই সাথে দুই সিটিতে ২০টি আঞ্চলিক (জোন ভাগ) কার্যালয় থেকে নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মশক নিধনের জন্য বলা হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার গণমাধ্যমকে নগরীতে মশকের উৎপাত সম্পর্কে বলেন, ‘জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে নগরীতে কিউলেক্স মশা বাড়ছে। এভাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত মশা আরো বাড়বে।’
‘মশা বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরবাসীর কষ্ট সহজেই অনুমান করা যায়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দুই সিটি করপোরেশনের উচিত ডেঙ্গুর মতো কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণেও পদক্ষেপ নেওয়া। তা না করলে এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে আমরা ডিএনসিসিতে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি। তবে তারা কাজ করছে কিনা, তা জানি না।’
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এক বাসিন্দা জামাল মিয়া বলেন, ‘আগে মাঠপর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম তদারকি করতেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। তবে গত ৫ আগস্টের পর সিটি করপোরেশনের সব ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় এখন মশার উপদ্রব নিয়ে কারও কোনো জবাবদিহি নেই। কে মশা নিধন করবে। বর্তমান প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগর বাসি›র ভোগান্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া।’
মিরপুর পীরেরবাগে আবুল কালাম বলেন, ‘মশা এখন প্রতিটি সময়ের সাথী। দিনেও মশারি লাগে, রাতেও মশারি, কী একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে! অথচ মশা নিধনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। এখন তা চরম আকার ধারণ করেছে।’
শ্যামপুরের আবদুর রহিম বলেন, ‘এডিস মশার উপদ্রব অনেক বেড়েছে। এখন সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা বা গলিতে দাঁড়ালেই মৌমাছির মতো চারদিক থেকে ঘিরে ধরে মশা। মশার কারণে বাচ্চাদের নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়।’
সূত্র মতে, ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে চলতি অর্থবছরে মশা নিধনে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে তারা। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকা এবং বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক ও মশা নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। এই টাকা দিয়েই ডিএনসিসির সবগুলো ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
অপরদিকে ডিএসসিসিতে মশক নিধন প্রসঙ্গে নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডিএসসিসিতে এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছে । বছরব্যাপী সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রনের অংশ হিসেবে সকালে নিয়মিত লার্ভিসাইডিং এবং বিকালে ফগিং করা হচ্ছে। হ্যান্ড মাইকে সকালে লার্ভিসাইডিং এর সময় জনসচেতনতা মূলক জিংগেল বাজানো হয়। বড় জলাশয়/নর্দমা সমূহে হুইল ব্যারো মেশিনের মাধ্যমে লার্ভিসাইডিং করা হয়। কিছু দিন পূর্বে কিউলেক্স মশা দমনে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ কর্মসূচী পালন করা হয়। উক্ত কর্মসূচীতে নিয়মিত মশককর্মীর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখক পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক অংশগ্রহণ করে। মশক নিয়ন্ত্রনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
তাদের দাবি, সে অনুযায়ী কার্যক্রমও চলছে। তারপরও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এজন্য ২০ থেকে ৩১ জানুয়ারি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করেছে তারা। ডিএসসিসি সূত্র জানায়, মশা নিধনে ডিএসসিসি চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রেখেছে ৪৪ কোটি টাকা। তবে প্রয়োজনে বরাদ্ধ আরও বাড়ানো হবে।