নিজস্ব প্রতিবেদক: নির্দোষ হয়েও জেল ক্যালেন্ডার হিসেবে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে কারাগারে বন্দী জীবনযাপন করছেন ইফতেখার বেগ ঝলক। এমনকি অন্য কোন আসামি ও সাক্ষীরা জবানবন্দীতে তার নাম বলেননি। আসামির বিরুদ্ধে কোথাও কোন তথ্য প্রমান না পেলেও তাকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু সাজা।
অভিযোগ রয়েছে প্রভাবশালী বাদীপক্ষ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাকসুদুর রহমানের উপর প্রভাব খাটিয়ে ঝলককে এই মিথ্যা মামলার আসামী করেন এবং অমানবিক নির্যাতন করে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেন। এই মামলায় হাইকোর্ট আসামি ঝলককে বেকসুর খালাস দিলেও আপিল বিভাগ খালাস বাতিল করে আমৃত্যু সাজা প্রদান করেন ! মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, ঢাকার ওয়ারীর হেয়ার ষ্ট্রীটে শপিংমলের জন্য বাড়ির নিচ তলা ও ২য় তলা কথিত মালিক ডাঃ তোফাতুন নাহারের কাছ থেকে ভাড়া নেন মনিরুজ্জামান ও ঝলক সহ চারজন পার্টনার শপিংমলের জন্য ডেকোরেশন করতে গিয়ে বাড়িওয়ালার সাথে মনমালিন্য হয়। ভাড়াটিয়া ঝলক ও তার পার্টনাররা এ্যাডভান্স টাকা ফেরত চান। বাড়িওয়ালা ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। এ
রপর ঝলক ও তার বন্ধুরা শপিংমলের পরিবর্তে ঝলকের নামে ট্রেড লাইসেন্স ও লিখিত দলিল তৈরি করে “ম্যাকয়” নামে একটা চাইনিজ রেস্তোরা চালু করেন। কিন্তু বাড়ির গ্যাস বিল বকেয়া থাকায় তিতাস কর্তৃপক্ষ চাইনিজের গ্যাস লাইন কেটে দিলে ঝলক গ্যাস সংযোগ দেয়ার জন্য বাড়িওলাকে অনুরোধ করেন ! কিন্তু বাড়িওলা গ্যাস না দিয়ে উল্টো বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেন এবং চাইনিজে তালা মেরে দেন !
ঝলক ও তার পার্টনাররা তখন সূত্রাপুর থানায় জিডি করেন ! এমতাবস্থায় ২০০৮ সালের ২৩ মে সন্ধায় চাইনিজের সামনের রাস্তায় বাড়িওলার ছেলে আশিকুর রহমান খান অপু সন্ত্রাসীদের দ্বারা খুন হলে বাড়িওলার মেয়ে কেয়া সন্ত্রাসী খুনিদের নামের সাথে ঝলকের নামও সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে সূত্রাপুর থানায় এজহারে লিপিবদ্ধ করেন !
২০০৮ সালের ২৫ মে ঝলক খবরের কাগজে আসামিদের তালিকায় তার নাম দেখে অবাক হয়ে বিস্তারিত জানার জন্য থানায় গেলে থানা কর্তৃপক্ষ তাকে আটকে রাখে এবং পরে গ্রেফতার দেখিয়ে ডিবিতে চালান দেয়া হয় ! ডিবি মাকসুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি টিম ঝলককে চোঁখ বেধে ডিবি অফিসে নিয়ে যান এবং বাদী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অমানবিক টর্চার চালান ! পরবর্তীতে রিমান্ডে নিয়ে জোরপূর্বক ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী আদায় করেন !
জেলে চালান দেয়ার পর ঝলকের সাথে জেল গেটে তার আইনজীবী এবং আত্মীয় স্বজন দেখা করতে গেলে ঝলক তার ভাঙ্গা দাঁত, ক্ষতিগ্রস্ত চোঁখ এবং সারা গায়ের ক্ষত চিহ্ন দেখিয়ে ডিবির অমানবিক নির্যাতনের কথা ব্যক্ত করেন ! তিনি আরো বলেন, তার কোটি টাকার চাইনিজ রেস্তোরাঁ থেকে অবৈধভাবে তাকে উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যেই বাড়ির মালিক ষড়যন্ত্র করে এই মিথ্যা মামলায় তাকে জড়িয়েছে ! মামলায় যাদের সাক্ষী ও আসামি করা হয়েছে তাদের কেউই জবানবন্দীতে ঝলকের নাম উল্লেখ করেনি ! এমনকি মৃত অপুর ভাই সেতুর বন্ধু প্রত্যক্ষ সাক্ষী রাজিবও তার জবানবন্দীতে অন্যদের নাম বললেও ঝলকের নাম বলেনি, তাকে ঘটনাস্থলে দেখেওনি বলে জানিয়েছে । উল্লেখ্য উক্ত মামলায় ২০১২ সালের ১৩ মার্চ জজকোর্ট দুই আসামিকে মৃত্যুদন্ড, ঝলক সহ চার আসামিকে যাবজ্জীবন এবং বাকি আসামিদের খালাস দেন ! পরবর্তীতে হাইকোর্টে ঝলক আপিল করলে ২০১৮ সালে কোর্ট ঝলককেও খালাস আদেশ দেন ।
কিন্তু হাইকোর্টের রায় চেম্বার কোর্ট স্থগিত করেন এবং পুনঃ শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন ! অর্থ অভাবে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে সিনিয়র আইনজীবী ধরতে না পারায় শুনানি শেষে ২০২৪ সালের ৪ জুন আপিল কোর্ট ঝলকের সাজা বাড়িয়ে আমৃত্যু সাজার রায় দেন ! কিন্তু রায় লিখিত হওয়ার আগেই জুলাই আন্দোলনে সকল বিচারপতি পদত্যাগ করলেও রায় বলবত রাখা হয় !
এই বিষয়ে ঝলকের ছোট ভাই মুক্তি বলেন, আমার ভাই ঝলককে ষড়যন্ত্র করে অন্যায় ভাবে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছে, সে চাইনিজ চালালেও এই হত্যাকান্ডের সাথে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই, ওই দিন সে ঘটনাস্থলেই ছিল না, বাদী ছাড়া কেউ তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি সাক্ষ্যও দেয়নি ! উদ্দেশ্য মূলক ভাবে বাদী পক্ষ তাকে এই মামলায় ফাঁসিয়ে তার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে ! ঝলক ভাইয়ের চিন্তায় চিন্তায় ২০১৪ সালে বাবা মারা গেছেন, তার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বৃদ্ধা মাও গত বছর চিরবিদায় নিয়েছেন ! বাবা মা আর নিজ সংসার হারিয়ে ঝলক ভাই এখন নিঃস্ব অসহায়ের মত অমানবিক বন্দী জীবন কাটাচ্ছে ! তার জীবন হুমকির সম্মুখীন ! আমরা তার দীর্ঘ বন্দী জীবনের অবসান চাই ! সরকার ও আদালতের কাছে এটাই আমাদের এখন একমাত্র দাবী !