অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক
এখন নতুন করে আর কোনও ব্যাংককে একীভূত হবার অনুমতি দিবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সিদ্ধান্ত আগামী তিন বছরের জন্য। এ পর্যন্ত পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া বা আলোচনা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক গতকাল বলেন, ‘আগামী তিন বছরের মধ্যে আর কোন ব্যাংকের একিভূত হওয়ার অনুমোদন দিবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। যে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার আলোচনা রয়েছে সেগুলোর কাজ সম্পর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে আর কোন ব্যাংকের একীভূত হওয়ার অনুমোদন দেয়া হবে না।’
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত ভাল ব্যাংকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার জন্য এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিলো। তা নাহলে আগামী বছর থেকে একীভূতকরণে অনেক ব্যাংককে বাধ্য করা হবে বলে জানানো হয়েছিলো। রোজার ঈদের আগে ‘স্বপ্রণোদিত হয়ে ব্যাংক-কোম্পানির একীভূতকরণ সম্পর্কিত নীতিমালা’ জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই প্রক্রিয়াকে একীভূতকরন বলা হলেও আদতে অপেক্ষাকৃত ভাল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংককে অধিগ্রহণ করবে।
এখন এই প্রক্রিয়ায় কেন বিরতি তার ব্যাখ্যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকএর মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘ওই পাঁচটি ব্যাংকের নিরীক্ষার জন্য পাঁচটি অডিট ফার্ম নিয়োগ দিতে হবে। এই নিরাক্ষাও সময়ের ব্যাপার। তাই এই পাঁচটি ব্যাংকের সব ধরণের কাজ শেষ হওয়ার পরে অন্য ব্যাংকের একীভূত হতে চাইলে তখন দেয়া যেতে পারে। তবে আপতত কেউ সেচ্ছায় চাইলেও আর একীভূত হওয়ার অনুমোদন দিবে না বাংলাদেশ ব্যাংক।’
সম্প্রতি বেসরকারী খাতের পদ্মা ও ন্যাশনাল ব্যাংক, এবং রাষ্ট্রীয় খাতের রাকাব, বেসিক ও বিডিবিএল ব্যাংকের অন্য ব্যাংকের সাথে একীভূত বা বিলীন হওয়ার প্রক্রিয়া বা আলোচনা শুরু হয়েছে।
এর মধ্যে শুধু পদ্মা ব্যাংকের সাথে এক্সিম ব্যাংকের চুক্তি হয়েছে । বাকি চারটির শুধু আলোচনা হয়েছে । এখনও কোনও চুক্তি হয়নি।
ইউসিবি ব্যাংকের সাথে ন্যাশনাল ব্যাংক, বিডিবিএলের সাথে সোনালী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের সাথে বেসিক ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংকের সাথে রাকাব বা রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের একীভূত হওয়ার আলোচনা হয়েছে।
এর মধ্যে কাগজ-কলমে ন্যাশনাল ব্যাংকের ও রাকাবের খেলাপি ২৬ শতাংশ। বাস্তবে আরো বেশি। বেসিকের ৬২ শতাংশ ও বিডিবিএলের ৪৪ শতাংশ খেলাপি রয়েছে।
৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠকে গভর্নর জানান, চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে। এর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বাকি চারটির একীভূত হওয়ার আলোচনা চলছে।
এই প্রক্রিয়ায় যেগুলো আলোচনায় ছিল, তার মধ্যে একটি এবি ব্যাংক, যার খেলাপি পরিমাণ ১২ শতাংশের মত। এছাড়াও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, এবং বিদেশী ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ইসলামী ব্যাংকের সাথে একীভূত হতে পারে বলে আলোচনায় ছিল। এছাড়াও গুঞ্জন ছিলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, গ্লোবাল ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক একীভূত হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একীভূত (মার্জার) করতে একটি রোডম্যাপ ঠিক করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এক বছর সময় দিয়ে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার, মূলধনের পর্যাপ্ততা, নগদ অর্থের প্রবাহ, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আর্থিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচক ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সেই সূচকে কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোকে ‘দুর্বল’ শ্রেণিভুক্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক টেনে তোলার শেষ পদক্ষেপ হিসেবে অন্য ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার এই প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯ শতাংশ। এছাড় অর্থ ঋণ আদালতে ২ লাখ কোটি টাকার অর্থ মামলায় আটকে রয়েছে। যা খেলাপি হিসেবে গণ্য করলে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার মত হবে খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শুধু ব্যাংক একীভূত করেই ব্যাংক খাত ঠিক করা যাবে না। পাশাপাশি বেনামি ঋণ ও যেসব ঋণ খেলাপি দেখানো হচ্ছে না, তাও খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া ‘যেসব ব্যাংক দুর্বল, তার তালিকা করে খারাপ সম্পদগুলো আগে আলাদা করে ফেলতে হবে। এরপর ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়ার আহ্বান জানালে সেটা ভালো হবে। চাপ দিয়ে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে খারাপ ব্যাংক একীভূত করলে তা ভালো ফল নাও দিতে পারে। এছড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবক্ষেত্রে সম-আইন প্রয়োগ শুরু করতে হবে। কাউকে রেখে কাউকে ধরার দিন শেষ হয়ে গেছে। সবার আগে আমানতকারীদের অর্থের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তারপরে একীভূত করতে হবে ব্যাংক।,
বাংলাদেশ ব্যাংক যে একীভূতকরণ নীতমালা জারি করেছে তাতে উল্লেখিত বিষয়ের সঙ্গে চারটি সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে। দুর্বল ব্যাংক অধিগ্রহণ করলে খেলাপি ঋণ ও পুঞ্জীভূত লোকসানের পুরোটা বহন করতে হবে গ্রহীতা ব্যাংককে। তবে এ জন্য নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে (প্রভিশন) বিশেষ ছাড় পাবে তারা। এর বাইরে সরকারি বিশেষ নীতি সহায়তাও দেওয়া হবে।
নীতিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলেছে, ‘অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকের বিদ্যমান সমস্যা সমাধান এবং একই সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের কার্যক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা; যাতে করে জনস্বার্থে একীভূত ব্যাংক-কোম্পানি অধিকতর সেবা প্রদান করতে পারে।’
নীতিমালায় বলা হয়েছে নিরীক্ষা এবং আর্থিক ও আইনি কাজ সম্পন্ন করার খরচ বহন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারী, পাওনাদার ও শেয়ারহোল্ডারদের দাবী পরিশোধসহ সম্পূর্ণ একত্রীকরণ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষা ফার্ম তার নিরীক্ষা এবং আর্থিক ও আইনি কার্যক্রম প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিবে। এসব বিষয়ে তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার অনুমোদন বাতিলও করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেশের ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২টির অবস্থা খুবই খারাপ, তারমধ্যে ৯টি ব্যাংক ইতোমধ্যে রেড জোনে চলে গেছে। অন্য ৩টির অবস্থান ইয়েলো জোনে অর্থাৎ রেড জোনের খুব কাছাকাছি রয়েছে বলে সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুন থেকে অর্ধ-বার্ষিক আর্থিক কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য ব্যাংকের স্বাস্থ্য সূচক তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগ।