ফিচার ডেস্ক : সারা দেশে জেঁকে বসেছে শীত। এই মৌসুমে তরতরিয়ে বেড়ে যায় শরীরের ওজন। এর কারণ হলো, শীতকালে বিয়ে-খতনাসহ নানা উৎসব লেগেই থাকে। জমিয়ে চলে ভূরিভোজ। নিয়মহীন খাওয়াদাওয়ায় মেতে ওঠেন অনেকেই। ফলে ওজন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
পুষ্টিবিদদের মতে, প্রতিদিন মানুষ যতটা ক্যালরি গ্রহণ করে সেটা যদি দেহে শুধুই জমা হতে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে শরীর মোটা হতে থাকে। তাই দেহের ওজনটা ঠিক রাখতে ক্যালরি ক্ষয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি।
তবে শীতকালে ওজন কমানো একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শীতে শরীরের মেটাবলিজম হার কমতে থাকে, সেই সাথে শারীরিক কার্যকলাপের পরিমাণও কমে যায় এই সময়ে। শীতকালে খাওয়া-দাওয়ার পরিমাণও বাড়ে। সব মিলিয়ে বাড়তে থাকে ওজন।
শীতে স্বাস্থ্যকর উপায়ে এবং দীর্ঘমেয়াদে ওজন কমানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে স্থায়ীভাবে আপনার খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামে পরিবর্তন আনা। কিছু ছোট পরিবর্তন যেমন কম খাওয়া এবং ফ্যাট, চিনি ও অ্যালকোহল যুক্ত পানীয় পান থেকে বিরত থাকলে তা আপনার ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে।
অনেকেই মোটা হওয়ার ভয়ে একেবারেই খাবার কমিয়ে দেন। খাওয়া কমিয়ে দিলে ওজন কমে ঠিকই কিন্তু শরীরে দেখা দেয় নানা ধরনের সমস্যা। তাই নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ এবং এমন খাদ্য নির্বাচন করা জরুরি যা খেলে ওজন বৃদ্ধি হবে না কিন্তু শরীর তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি ঠিকই পাবে।
শীতকালে নানা কারণে বেড়ে যেতে পারে ওজন। কিছু নিয়ম মেনে চললে বশে থাকবে ওজন। শরীর থাকবে চনমনে।
শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করা সত্যিই দুষ্কর। কিন্তু শরীর তো সে কথা মানবে না। সঠিক যত্নআত্তি না পেলে ওজন বাড়তেই থাকবে। এত দিনের রোগা হওয়ার পরিশ্রম, শুধু আলসেমির কারণে চলে যাবে? তেমনটি না চাইলে শরীরচর্চা করা থেকে একেবারে বিমুখ না হওয়াই ভালো। শীতকালে বেলার দিকে বেশ একটা মিষ্টি রোদ ওঠে। সেই সময়ে শরীরচর্চা করতে পারেন।
শীতের সকালে হাঁটার ফলে বিশুদ্ধ বাতাস ও সুন্দর পরিবেশ আপনার হৃৎপিণ্ড ও মনের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। হাঁটার সময় হৃৎপিণ্ড শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করে। ফলে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ ও সচল থাকে এবং মানুষ দীর্ঘজীবী হয়।
আপনি কতটুকু ব্যায়াম করবেন তা আপনার লিঙ্গ, বয়সের উপর এবং কাজের ধরনের উপর নির্ভর করবে। হাঁটা হলো সব ধরনের ব্যায়ামের মধ্যে সবচেয়ে উপকারী। প্রতিদিন সকালে অন্তত ২০ থেকে ৩০ মিনিট টানা হাঁটার অভ্যাস করুন। কারণ এই হাঁটা সারা দিন ভালো থাকতে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
পেটের অতিরিক্ত মেদ কমাতে ও সবল থাকতে ক্রাঞ্চেস ব্যায়াম করতে পারেন। বিছানায় শুয়ে হাঁটুকে ৯০ ডিগ্রি কোণে বাঁকিয়ে হাত দুটি মাথার নিচে রাখুন। মাথা ও ঘাড় সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে কিছুক্ষণ এই ভঙ্গিতে থাকুন। এছাড়া হিপ ব্রিজ ব্যায়াম মেদ কমাতে বেশ কার্যকর। বিছানায় শুয়ে পায়ের সাহায্য কোমর থেকে নিতম্ব পর্যন্ত তুলুন। হাত দুটি শরীর স্পর্শ করে পাশে রাখুন। কোমরের মেদ কমাতে সাহায্য করে ‘হিপ ব্রিজ’।
উৎসব আসবে, আবার চলেও যাবে। কিন্তু ওজন একবার বেড়ে গেলে তা কমানো অত্যধিক পরিশ্রমের। তাই আগে থেকেই সতর্ক থাকুন। মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে পছন্দের খাবার একেবারে খাবেন না, তা নয়। পরিমাণে কম খান। ক্যালোরি কম আছে, এমন কিছু খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। কাজের ফাঁকে মুখ চালাতে সঙ্গে রাখতে পারেন বাদাম, আখরোট, খেজুরের মতো স্বাস্থ্যকর কিছু খাবার।
শীতে পানির তেষ্টা অনেক কম পায়। একবার পানি পান করলে অনেকক্ষণ আর পানি পান করার কথা মনে থাকে না। পিপাসা না পেলেও শীতকালে নিয়ম মেনে পানি পান করা জরুরি। পানি ভেতর থেকে আর্দ্র রাখবে। তাতে বাইরের খাবার খাওয়ার প্রবণতাও অনেকটা কম তৈরি হবে।
দুধ, চিনি দেওয়া চা-কফির পরিবর্তে ব্ল্যাক টি বা কফি খাওয়া শুরু করেন। হারবাল টি, ব্ল্যাক টি বা ব্ল্যাক কফিতে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে। প্রতিদিন এই চা-কফি পান করলে মেটাবলিজম বৃদ্ধি পায় এবং তা ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে।
হালকা গরম পানি পানের বিভিন্ন উপকারিতা রয়েছে। যেমন—এটি দেহের অতিরিক্ত ফ্যাট ভেঙে দেয় এবং সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে। তদুপরি শীত মৌসুমে আদা, লং ইত্যাদি হার্বাল চা তো আছেই। তাই ওজন কমাতে কুসুম গরম পানি খুবই উপকারী।
শীতকালকে ওজন কমাতে কাজে লাগাতে চান, তবে ভারী খাবার গ্রহণের ৩০ মিনিট আগে স্যুপ গ্রহণ করুন। এতে ভারী খাবার বেশি খাওয়া হবে না। ফলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ না করেও ক্ষুধা মিটবে।
দেহের ওজন কমাতে শীতকালীন শাকসবজি বেশ কার্যকর; এমনকি উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল কমাতেও শীতকালীন সবজির জুড়ি নেই। এ সময়ে হাতের নাগালেই পাওয়া যায় নানা ধরনের ভেষজ প্রোটিন, কম ক্যালরি ও অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ শাকসবজি। এ জন্য খেতে পারেন টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালংশাক, শালগম ইত্যাদি।
এসব শাকসবজিতে আঁশ বিদ্যমান। ডায়েটে এদের যুক্ত করলে ক্যালরির ঘাটতিও পূরণ হবে। তবে শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী কোন খাবার কতটুকু খাওয়া উচিত তা পুষ্টিবিদের কাছে জানা যায়।
শীতে নারিকেলের শাঁস খেতে পারেন। নারিকেলের শাঁসে প্রচুর ফাইবার থাকে। এছাড়া নারিকেলের শাঁস দেহে চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে। ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণেও এর জুড়ি নেই।
শীতকালে প্রাকৃতিক উপাদানে প্রস্তুত কিছু পানীয় রাখতে পারেন, যা ওজন কমাতে ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও বেশি সাহায্য করবে। এক মগ পানিতে ১ চা চামচ মধু, ১ চা চামচ হলুদ ও ১ চিমটি কালো মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে পান করুন সকালে খালি পেটে। এই পানীয় শুধু ওজন কমাতেই নয় বরং সর্দি-কাশি সাইনোসাইটিসের সমস্যা সারাতে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
শীতে শরীরের ওজন কমাতে ভেষজ আমলকির চা খতে পারেন। আমলার রস ও এর নির্যাস বিপাক বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে দ্রুত ওজন কমে। তাছাড়া আমলায় থাকা ফাইবারের উপস্থিতি অন্ত্রের গতি কমাতে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, হজম নিয়ন্ত্রণ করে ও অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে।
নিয়মিত আমলকির চা খেলে দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করে, কারণ এটি প্রাকৃতিকভাবে শরীরকে ডিটক্সিফাই করে। আমলকি চা তৈরি করতে একটি পাত্রে ২ কাপ পানি গরম করুন। এতে ১ চা চামচ গ্রেট করা আদা, ২টি তুলসি পাতা ও ১ চা চামচ শুকনো আমলা গুঁড়া মিশিয়ে মিশ্রণটি ফুটিয়ে নিন। এরপর এটি ছেঁকে মধু ও এক চিমটি কালো মরিচ মিশিয়ে পান করুন।
বাসা থেকে বের হয়ে শীতে দাপটে হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে উঠলে পালানোর চেষ্টা করবেন না। গবেষণায় জানা গেছে, চর্বি ও পেশির মধ্যে নির্দিষ্ট হরমোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রয়েছে যা সাদা কোষকে বাদামি কোষে রূপান্তরিত করে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করে। যখন আমাদের শীত লাগে ও শরীর কাঁপুনি দেয় তখন পেশি থেকে সৃষ্ট হরমোন আইরিসিন এবং বাদামি চর্বি থেকে সৃষ্ট প্রোটিন এফজিএফ ২১ বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, ১০ থেকে ১৫ মিনিট কাঁপুনি এক ঘণ্টা মাঝারি ব্যায়ামের সমান কাজ করে।
শীতে মনখারাপ জাঁকিয়ে বসে মন জুড়ে। অনেক দিনের অবসাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই ‘সিজ়ন্যাল ডিপ্রেশন’-এর সমস্যায় অনেকেই ভোগেন। অবসাদ কিন্তু ওজন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। তাই মনখারাপ হলেও তা বেশি ক্ষণ পুষে রাখবেন না।