সিলভিয়া নাজনীন: স্যার, আপনার শৈশব থেকেই শুরু করতে চাই। আপনার বেড়ে ওঠা তো পুরান ঢাকায়?
রফিকুন নবী: পুরান ঢাকা—এখানে ‘পুরান’ কথাটা না হলেও চলে। নতুন দিল্লি, পুরান দিল্লি—এ রকম একটা ভাবনা থেকে পুরান ঢাকা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি বলি যে ওটাই ঢাকা। আমার জীবনের মৌলিক যে অভিজ্ঞতা, সেটা অর্জন হয়েছে এখান থেকে। আমি যে পোগোজ স্কুলে ভর্তি হলাম, স্কুলের দিনগুলো থেকেই আমার এই ঢাকাকে দেখার শুরু। এখন এই যে দূরে থাকি, মানে ‘নতুন ঢাকা’য় থাকি, দূরে থাকার ফলে মনে হয় ওই ঢাকাটা সত্যিই অন্য রকম ছিল। অনেক কিছু ছিল। তখন অতটা বুঝিনি। আমি টোকাই আঁকলাম, পথশিশুদের নিয়ে কাজ করেছি, নানা কিছু করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, একেবারে ছোটবেলায় যখন প্রাইমারিতে পড়তাম, তখন পথশিশুরা আমার বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে মেলামেশা, খেলাধুলা করেছি। তারা অনেক বুদ্ধিমান ছিল, তাদের বুদ্ধির একটা নির্যাস আমার মধ্যে থেকে গিয়েছিল।
সিলভিয়া: আপনার ছবি আঁকতে আসার পেছনে আপনার বাবার ইচ্ছা একটা বড় ব্যাপার ছিল বলে শুনেছি।
রনবী: সবাই জানে, আমার ছবি আঁকার পেছনের অনুপ্রেরণা আমার বাবা। তিনি নিজে ছবি আঁকতেন, যদিও পুলিশে চাকরি করতেন। পুলিশে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বলতেন, এই ছবি আঁকা মানুষ পুলিশে মানায় না। আমার জীবনে বাবার অবদানটা অনেক বড়। তাঁর অবদানের সূত্র ধরেই হয়তো আমার জীবনে কখনোই কিছু ঠেকে থাকেনি। আর আমার আর্ট কলেজে ভর্তির ব্যাপারে আমি কিছুই বলিনি। বাবাই সব ঠিকঠাক করে বলে দিলেন, ‘তুই আর্ট কলেজে ভর্তি হবি।’
সিলভিয়া: পরে তো আর্ট কলেজের মাস্টারও হলেন…
রনবী: আমি কোনো দিন মাস্টার হতে চাইনি। আমার যখন রেজাল্ট বের হলো, ভালো রেজাল্ট দেখে আবেদিন স্যার আমাকে ডেকে বললেন, তুমি সোমবার থেকে ক্লাস করাবে। ব্যাপারগুলো আপনাআপনিই হয়েছে। এমনকি আমার বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারটাও, আমি কখনোই স্কলারশিপের চেষ্টা করতাম না। স্বাধীনতার পর বাহাত্তর সালে, হঠাৎই একটা মিটিং হলো চারুকলায়, শিক্ষকদের কক্ষে ডেকে পাঠানো হলো আমাকে। আমি তখন তরুণ শিক্ষক। গেলাম। জানলাম, গ্রিস সরকারের একটা স্কলারশিপ এসেছে। আজই চারুকলা থেকে একটা সিলেকশন দিতে হবে। কাইয়ুম স্যার থেকে শুরু করে হাশেম স্যার—যাঁরা তখনো বিদেশে যাননি, কেউই গ্রিসে যেতে রাজি নন। আর আমার তখন একেবারে নতুন সংসার, আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছাও নেই। এসব নিয়ে কোনো ভাবনাও নেই। তা ছাড়া এখানকার বইয়ের বাজার ও পত্রপত্রিকায় সে সময় আমার নাম প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, ভালো একটা অবস্থান তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে বললাম যে, আমি যাব না। কিন্তু ওই যে অটোমেটিক—আগে থেকেই যেন সব ঠিক হয়ে আছে। তখন স্যাররা আমাকে পটিয়ে-ফটিয়ে রাজি করিয়ে ফেললেন। জীবনে আমি কখনো কাউকে বলিনি, ভাই, ছবি-টবি কেনো বা পত্রপত্রিকাগুলোকেও কখনো বলিনি, আমাকে একটু কার্টুন করার সুযোগ দাও। সব নিজেই এসেছে।
সিলভিয়া: চারুকলায় দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন। এই জীবনটা নিয়ে কিছু শুনতে চাই।
রনবী: আবেদিন স্যারের হুকুমে আমি শিক্ষকতায় ঢুকেছিলাম। স্যার বলেছিলেন, ভালো না লাগলে ছেড়ে দিয়ো। এটা কোনো জোরাজুরির ব্যাপার না। আর পয়সাটাও বড় কথা নয়। ইত্যাদি বলে তিনি আমাকে ঢোকালেন। কিন্তু আমি ওই যে ঢুকলাম, ধীরে ধীরে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম যে বাইরের বিভিন্ন তৎপরতার সঙ্গে থাকলেও এটাকে আর ছাড়তে পারিনি। এই যে শিক্ষকতা—এর একটা আলাদা ব্যাপার আছে। চারুকলার যে পরিবেশ, তার সঙ্গে সম্পৃক্ততার একটা আলাদা গুণ আছে। এখনো আমি ছাত্রদের বলি, দেখো চারুকলায় ভর্তি হয়েছ, ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলে মানে সারা বিশ্বের শিল্পকলার সঙ্গে একটা সম্পৃক্ততা হয়ে গেল।
যাহোক, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলে বলব, এটা একটা যাত্রা। ছাত্রদের সঙ্গে বসা, কথা বলা, তাদের গতিপ্রকৃতি দেখা এবং নিয়ে ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তা করা—এই সব। একদিকে আমাদের শিল্পীজীবন, আরেক দিকে শিক্ষকতা। শিল্পকলা নিয়ে কাজ করছি বলে সেটা শেখার একটা চেষ্টাও থাকে। এর মধ্যে একটা মজা আছে। অন্য শিক্ষকদের মতো আমিও মজাটা পেয়েছি। তবে সবই যে ভালো তা বলব না, মন্দ দিকও আছে। সব ছাত্রের প্রিয়ভাজন হওয়া কখনো সম্ভব নয়। একইভাবে সব সহকর্মী যে একেবারে সব সময় বন্ধুভাবাপন্ন থাকবে, সেটাও নয়। সবকিছু মিলিয়েই আমাদের শিক্ষক-জীবন।
সিলভিয়া: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও গ্যালারি চিত্রকে এখন আপনার ছবির আনুপূর্বিক প্রদর্শনী চলছে। সেই প্রদর্শনী দেখে একটা বিষয় মনে হলো, প্রায় সময়ই আপনার ছবিতে পরিবার বিষয় হয়ে আসে। সাংসারিক ঘরোয়া ব্যাপারগুলো কি আপনার কাছে বিশেষভাবে ধরা দেয়?
রনবী: পরিবার নিয়ে আমার অনেক কাজ আছে। এখনো মনে হয়, আবার পরিবার নিয়ে কাজ করি। পরিবারে একটা বাঁধন থাকে। বাচ্চারা যেভাবে মায়ের ওপরে ভরসা করে তাকে ঘিরে থাকে—ব্যাপারগুলো ছবিতে আমি আনি। আসলে ছবির অ্যারেঞ্জমেন্ট, ফিগার—এগুলো বড় কিছু নয়, ফিগার হলো অনুষঙ্গ। আমি মনে করি, সাজানোটাই আমার ছবির প্রধান ব্যাপার। একটা বাঁধন বা বিষয়কে মাঝখানে রাখা হলো, তারপর চারদিকে অন্য ফর্মগুলো ছড়িয়ে দিলাম। সেই ছড়ানো ফর্মগুলো ঘরের সাজেশন দিতে পারে বা নিছক রঙের সাজেশন। মূল বিষয় হলো, মাঝখানে যে বিষয়টা দাঁড়াল, সেটাই। সবার সঙ্গে সবাই জড়ানো। এভাবে আমার ছবিতে বারবারই পরিবার এসেছে।