বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন না করে পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালির ওপর জুলুম নির্যাতন শুরু করে। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানিরা। এক পর্যায়ে বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নেয়। অধিকার আদায়ে শুরু হয় সংগ্রাম, অন্যদিকে চলে পাকিস্তানি নিপীড়ন। দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে লাল-সবুজের ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হয়।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে দেখা দেয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষসহ নানা প্রতিবন্ধকতা। অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে নতুন সরকার। এসব দেখে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে। তার সেই ধারণা ভুল প্রমাণ হয়েছে, মৃত্যুর আগে পরিবর্তিত উন্নয়নের বাংলাদেশ দেশে গেছেন তিনি। বিশ্ব আজ দেখছে সমৃদ্ধ-স্বনির্ভর বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। মেধা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে অর্থনীতি দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে এখন বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু ১৯৭২ সালে। সে সময়ে পাকিস্তান অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ থেকে এগিয়েছিল। এখন অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। যে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ, আজ ৫২ বছর পর আর্থ-সামাজিক প্রায় বেশিরভাগ সূচকেই তারা বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। এটাই স্বাধীনতার বড় অর্জন।
বিজয়ের ৫২ বছরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে আরও দ্রুতগতিতে। বিশ্ব নেতাদের কারো কারো মতে, বাংলাদেশ ‘উন্নয়নের রোল মডেল, কেউ বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’ কারো মতে, অফুরন্ত সম্ভাবনার এক বাংলাদেশ। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে অন্যরকম এক বাংলাদেশ দেখছি। বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
বাংলাদেশের উন্নতির সঙ্গে নিজ দেশের অর্থনীতির তুলনা করে ইমরান খান বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) যখন আলাদা হয়ে বাংলাদেশ হয় তখন আমাদের অনেকে বলেছিলেন, তারা (পূর্ব পাকিস্তান) আমাদের জন্য বড় মাপের বোঝা ছিল। নিজের কানেই আমি এসব শুনেছি। ‘সেই পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) আজ সবকিছুতেই এগিয়ে গেছে। তাদের দূরদর্শী চিন্তার জন্যই এমনটা হয়েছে।’
বেশিরভাগ সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। তুলনামূলক পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১২০ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের ছিল ১৮০।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৭৬৫ ডলার। সেখানে সংবাদ সংস্থা এএনআই-এর তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৭১ ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের জিডিপির আকার ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানিতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি আয় ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে পাকিস্তানের রপ্তানি আয় ২ হাজার ৭৪০ কোটি ডলার।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের র রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭৬ কোটি ডলার। ৫২ বছর আগে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল পাকিস্তানের অর্ধেকেরও কম। আর এখন পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের রপ্তানি। তৈরি পোশাক রপ্তানি চীনের পরই বাংলাদেশ, বিশ্বে অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশের মুদ্রার মানও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি, ১৯৭২ সালে যা বেশ কম ছিল। বর্তমানে ১ মার্কিন ডলারের সমান বাংলাদেশের ১১০ টাকা আর পাকিস্তানের ২৮৩ রুপি।