রমজান আলী: একে তো নেই বেচা-বিক্রি, তার ওপর আতঙ্কÑ কখন কী ঘটে? রাজধানীর ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের অবস্থা এখন তাই। কোটা সংস্কার আন্দোলন আর এরপর তাকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় কয়েকদিন ছিল না তাদের বেচা-বিক্রি, ফুতপাতে বসতেও পারেননি অনেকে। তারপর কারফিউতে তো প্রায় ঘরবন্দী।
পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর ফুটপাতে বসছেন পসরা সাজিয়ে, কিন্তু খুব একটা দেখা পাচ্ছেন না ক্রেতার। আর সারাক্ষণ খেয়াল রাখতে হয় আবার কিছু ঘটলো কিনা! কিন্তু পসরা নিয়ে তো বস্তেই হবে, কারণ পেটের দায়।
মতিঝিলের ফুপাতে কাপড়ের ব্যবসা করেন আনাস নামে এক ব্যক্তি। তিনি গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘দোকান ও শ্রমিদের খরচ ৩ হাজার টাকার উপরে। এখন বিকেল ৪টা। অথচ কোনো বিক্রি নাই। এই অবস্থা গত কয়েকদিনের। এইভাবে চলতে থাকলে পরিবার নিয়া না খায়া মরমু।’
কেন বিক্রি হচ্ছে না এই প্রশ্নের তার উত্তর, ‘মানুষ আতঙ্কের মধ্যে। দোকানে কখন কাপড় কিনতে আসবো?’
সেখানে প্রায় শ’খানেক দোকানের দিকে আঙুল তুলে আনাস বলেন, ‘দেখেন কোনো দোকানেই কাস্টমার নাই। এইভাবে দেশ চইলতে পারে না। অবস্থা খুবই খারাপ। কিছু মানুষের হাতে টাকা আছে। সাধারণ মানুষের কাছে টাকা নাই। আমরা খুবই কষ্টের মধ্যে আছি। আমাদের কষ্ট কেউ দেখে না।’
মতিঝিল মেট্রোরেল স্টেশনের পাশেই বসেন সিদ্দিক নামে এক কাপড় ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘খারাপের শেষ শব্দ জানি না, কিভাবে কমু কতোটা খারাপ অবস্থায় আছি। পরিবার নিয়া খুবই কষ্ট। গত কয়েকদিন কোন বেচাকিনা নেই। প্রতিদিন দেড় হাজার টাকার উপরে খরচ। তার ওপর এই চান্দা, সেই চান্দা। ব্যবসা হউক আর না হউক, চান্দা দিতেই হইবো।’
মতিঝিল বক চক্কর ফুটপাতে অনেকগুলো জুতার দোকান রয়েছে। নামপ্রকাশ না করার শর্তে একজনে বিক্রেতা বলেন, ‘বিক্রি অর্ধেকে নামছে। মানুষ খালি কাজের জন্য এখন বাইর হয়।’
মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের পেছনে অনেকগুলো চায়ের দোকান। নামপ্রকাশ না শর্তে একজন চা বিক্রেতা বলেন, ‘আন্দোলনের আগে যে পরিমাণ চা বিক্রি করতাম এখন তার অর্ধেকও পারি না। খরচ কিন্তু কমে নাই। দোকান খুললেই খরচ। মানুষ এখন আগের মতো রাস্তায় চলাফেরা করে না। তাই বেচা-কিনা আগের মতো না।’
পল্টন মোড়েও অনেকগুলো চায়ের দোকান। সেখানেও একই চিত্র। আগের মতো জমজমাট না। সাধারণত সেখানে অনেক লোককে দাঁড়িয়ে চা খেতে দেখা যেতো। আর গতকাল দেখা গেল অনেক ফাঁকা।
সেখানেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বললেন, ‘এইখানে ব্যবসা করন মানে মরণ হাতে নিয়া ব্যবসা করা। কারণ এখানেই যেকোনো আন্দোলনে ঝামেলা হয়। আতঙ্কে থাকতে হয় আমাগো। ক্ষতি সবসময় আমাগোই। কোনো গ্যাঞ্জাম লাগলেই দোকানপাট ভাইঙ্গা ফেলায়। যে কোনো আন্দোলনে কোনো না কোনো ক্ষতি আমাগোরই হইবো।’
গুলিস্থানে গিয়েও দেখা গেছে, আগের মতো মানুষের আনাগোনা নেই। ফুটপাতের দোকানে তেমন কোন বেচা-বিক্রিও নেই। সেখানেও যারা ফুতপাতে পসরা সাজিয়ে বসেছেন তাদেরও একই কথা বেচা-বিক্রি নাই বা খুবই সামান্য।
রাজধানীর পুরান ঢাকা বংশালে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা-বিক্রি ‘অর্ধেকে’ নেমে গেছে।
মালিবাগে ফুটপাতে শসা কেটে বিক্রি করেন রফিক নামে একজন । তিনি বলেন, ‘গরমে মানুষ শসা খাইতে পছন্দ করে। ফুটপাতে আগের মতো লোক না থাকায় বিক্রি অর্ধেকে নামছে।‘
তিনি বলেন আগে দেড়-দুই হাজার টাকার মতো কাটা শসা বিক্রি করতেন। এখন তা ১ হাজার টাকার নিচে নেমেছে।
তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হইবো আল্লাহই জানে। এইবভাবে চলতে থাকলে পথে বসতে বেশি সময় লাগবো না। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে তাদের খরচ আছে। প্রতি মাসে বাড়িতে ১০ হাজার টাকা পাঠাইতে হয়। কিন্তু বেচাকিনা এখন অনেক কম। এতো টাকা কিভাবে পাঠাবো চিন্তায় আছি।’
কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে ঘিরে গত ১৭ জুলাই থেকে ২০ পর্যন্ত ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নিয়েছিল। সহিংসতায় অনেকের প্রাণ গেছে। কয়েক হাজার লোক আহত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারির বিভিন্ন স্থাপনা আগুন, যানবাহনে ভাঙচুর, অগ্নিসন্ত্রাস হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ আনতে কারফিউ জারি করা হয়েছিল, যা এখনো চলামন।