নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া টাকা পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়। আর ঋণ অনিয়মের পেছনে ব্যাংকারদের দুর্বলতাই দায়ী বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে বিএফআইইউ’র বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। এবারই প্রথম সন্দেহভাজন ঋণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে আর্থিক এই গোয়েন্দা সংস্থা। যদিও ব্যাংক খাত থেকে গত দুই বছরে কত টাকার বেনামি ঋণ বেরিয়েছে তার তথ্য প্রকাশ করেনি সংস্থাটি। তদন্ত ও আইনি জটিলতার কারণে এ তথ্য প্রকাশ করছে না বলেও জানানো হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আর্থিক এই গোয়েন্দাদের কাছে সন্দেহভাজন ঋণের ৫২০ অভিযোগ দিয়েছে। এর আগে ২০২০-২১ অর্থ বছরে এই অভিযোগের সংখ্যা ছিলো মাত্র ৯৮টি। আর একবছর আগে এর পরিমাণ ছিলো ৩৪১টি। সে হিসেবে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দেশের ব্যাংক খাতে সন্দেহভাজন ঋণ সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণ বা ৪৩০ শতাংশ। সন্দেহভাজন ঋণগুলোর মধ্যে পরিশোধ সংক্রান্ত সমস্যা ১৮ শতাংশ, জালিয়াতির মাধ্যমে প্রাপ্ত ঋণের পরিমাণ ৭ শতাংশ, ইচ্ছাকৃত খেলাপি হচ্ছে ৩৬ শতাংশ, ঋণ নিয়ে অন্যখাতে ব্যবহার হয়েছে ২৭ শতাংশ, অন্যান্য খাতে ৬ শতাংশ এবং সন্দেহভাজন ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ মিডিয়ায় রিপোর্ট হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ব্যাংকগুলো আগে এই তথ্য দিতে ভয় পেতো। তবে তাদের অনেকভাবে বুঝানোর পর এখন তারা সন্দেহভাজন ঋণের তথ্য দিয়ে আমাদের সহায়তা করছে। এ ক্ষেত্রে তথ্য দাতার পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে। অনেক সময় ব্যাংকের পরিচালকদের চাপে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণ অনুমোদন করেন। এসব ঋণ অনুমোদনের পর আমরা তথ্য পেলে ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দিচ্ছি। অনেক সময় সংবাদ মাধ্যম থেকে তথ্য নিয়েও ঋণ অনিয়ম বন্ধে সংস্থাটি কাজ করে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বিএফআইইউর তথ্য বলছে, দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রম ব্যাপকহারে বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ১৪ হাজার ১০৬টি। এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ৫ হাজার ৫৩৫টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ২৮০টি। যদিও এই লেনদেনের পুরোটাই অপরাধ নয় বলে জানানো হয়েছে। তবে সন্দেহভাজন লেনদেন হলে তার তদন্ত করে সংস্থাটি। এরপর অপরাধের প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এদিকে দেশের বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে অর্থপাচার। পাচারের কারণেই দেশে ডলার সংকট ও আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে। এমনকি উচ্চমূল্যস্ফীতির জন্যও দায়ী করা হয় অর্থপাচারকে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশের সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় সেই ১০ দেশের সাথে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তির (এমএলএ) ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে সরকারকে এ বিষয়ে প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। সরকার এটি গ্রহণ করার পর দেশগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি সম্পন্ন হবে। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া দেশ হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং-চীন।
অর্থপাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান বলেন, দেশের অর্থপাচারের সিংহভাগই হচ্ছে বিদেশি বাণিজ্যের মাধ্যমে। অর্থাৎ আন্ডার ইনভয়েসিং আর ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যায়। তাই গত অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি মনিটরিং করে যাচ্ছে। এতে অর্থপাচার অনেকটাই কমে এসেছে।
মাসুদ বিশ্বাস বলেন, মানি লন্ডারিংয়ের ৮০ শতাংশ হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক যদি এটি বন্ধে সহযোগিতা না করে তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই অর্থপাচার রোধে ব্যাংকারদের আরও সচেতন হতে হবে। তাছাড়া ব্যাংকারদের অর্থপাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা আরও বেশি সচেতন হলে পাচার অনেকটাই কমে যাবে। এছাড়া অর্থপাচার ও সন্দেহভাজন ঋণ বন্ধ করতে শক্তিশালী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও জরুরি। না হয়, এগুলো বন্ধ সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, একবার যদি মানি লন্ডারিং হয়ে চলে যায়, সেটা ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন। সেটা আর ফিরে আসে না। আমরা ২০১২ সালে এমএলএ-অ্যাক্ট করেছি। আমরা ১০টি দেশে এমএলএ করার জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা নিয়ে কাজ করছে।
এখন পর্যন্ত বিদেশে পাচার হওয়া কত টাকা ফেরত আনতে পেরেছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানি লন্ডারিং একটা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম। এখানে বহু পক্ষ জড়িত থাকে, বহু দেশ জড়িত থাকে। আমাদের দেশের আইন আর অন্য দেশের আইন এক নয়। আমরা কিছু আছি সিভিল ল’ কান্ট্রির দেশ, কিছু আমি কমন ল’ কান্ট্রির দেশ। এটা নিয়েও ভাববার আছে। একটা উদাহরণ আমাদের কাছে আছে, সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়া ২০ লাখ ৪১ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার আমার ফেরত এনেছি। এটা কোকোর (আরাফাত রহমান) টাকা ছিল।
আরেক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের মামলা হয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে দুদক মামলা করেছে ৪৭টি, সিআইডি ১০টি এবং এনবিআরের বিশেষ সেল ২টি। এগুলো এখনো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরো অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮০৯টি সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। তার আগের অর্থবছরে ৭ হাজার ৯৯৯টি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রিপোর্ট জমা দেয় ১২১টি। আর এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ৯০০ রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
গত অর্থবছরে বিএফআইইউ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অনিয়মের তথ্য দিয়েছে ১৩৩টি। এর মধ্যে সিআইডিকে ৮৫টি, দুদুককে ৩৩টি, এনবিআরকে ১০টি এবং অন্যান্য সংস্থাকে ৫টি অনিয়মের তথ্য দিয়েছে। এসব অভিযোগগুলো তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয়।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফআইইউ বিভিন্ন দেশের কাছে পাচার সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে ২২টি। এসব তথ্যের অধিকাংশই পাইনি সংস্থাটি। এছাড়া বাংলাদেশের কাছে অন্যান্য দেশ থেকে অর্থপাচার সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে ৯০টি। যেগুলোর বেশিরভাগের তথ্যই বাংলাদেশ দিয়েছে।