নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। ঋণ বিতরণ করলেও আদায় করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বাড়াতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাথে সাথে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদহারও বেধে দিয়েছিল আর্থিক খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। তবে গত নভেম্বর মাসে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সুদের চেয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণে বেশি সুদ নিয়েছে।
সদ্য সমাপ্ত বছরের ৮ অক্টোবর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ও ঋণের সুদহার নিয়ে একটি নির্দেশনা জারি করেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দেশনায় বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের পর্ষদের অনুমোদনক্রমে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ দিতে পারবে। এছাড়া ঋণ বা লিজের বিপরীতে সর্বোচ্চ সুদ নিতে পারবে ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ।
তবে এর পরের মাস নভেম্বরেই নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণের সুদে দেখা গেছে অনিয়ম। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা না মেনেই মাসটিতে ঋণে বেশি সুদ নিয়েছে দেশের ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি কিছুটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। ডলার সংকট ও ব্যবসায় অস্থিরতার কারণে অনেকে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এর ফলে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপির হার অনেক বেশি তারা বর্তমানে দেওয়া ঋণে বেশি সুদ নিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান কিছুটা টিকে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে ঋণে সবচেয়ে বেশি সুদ নিয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড। এ মাসে প্রতিষ্ঠানটি সুদ নিয়েছে ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। এরপর অতিরিক্ত সুদ নেওয়ার তালিকায় রয়েছে ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড। আর্থিক খাতের এ প্রতিষ্ঠানটি ঋণে ১৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঋণে বেশি সুদ নেওয়ার তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। গত নভেম্বর মাসে ফারইস্ট ফাইন্যান্স ঋণে ১৫ শতাংশ সুদ নিয়েছে। এছাড়া আভিবা ফাইন্যান্স সুদ নিয়েছে ১৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড নিয়েছে ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ সুদ।
এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস লিমিটেড নিয়েছে ১৪ দশমিক ০৬ শতাংশ, ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড নিয়েছে ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড নিয়েছে ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড নিয়েছে ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ, সিভিসি ফাইন্যান্স লিমিটেড ঋণে সুদ নিয়েছে ১২ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা এই খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।
নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খারাপ অবস্থা নতুন কিছু নয়। দেশের আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অনিয়ম করেছিলো। পি কে হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ভঙ্গ করে ঋণে বেশি সুদ নিচ্ছে পি কে’র অনিয়মে জর্জরিত ছাড়াও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা বা ৯৯ শতাংশ, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) খেলাপির হার ৭৪৩ কোটি টাকা বা ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা বা ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ ছাড়া পি কে হালদার সংশ্লিষ্ট এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা বা ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ ও আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকা বা ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ।
এছাড়া ঋণে বেশি সুদ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৪১ শতাংশ, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ৮৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং সিভিসি ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ।