অর্থনৈতিক প্রতিবেদক:আ.লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপকমিটি চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের গুলশান-২ নিজ বাসা থেকে কাজের বুয়ার লাশ উদ্ধার করেছে গুলশান থানার পুলিশ।
গুলশান থানার এসআই মাজারুল ইসলাম জানান, গুলশান -২ কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের বাসা থেকে ফরিদা বেগম (৫০) নামে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ফরিদার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ। তার স্বামী মৃতু: বশির উদ্দিন।
তিনি আরো বলেন, ফরিদা বেগমের লাশ আমরা ময়নাতদন্তে দিয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলে বিস্তারিত জানাতে পারবে। কিভাবে লাশ পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা গিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলান্ত অবস্থায় মরদেহ উদ্ধার করি। গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস দেয়া ছিলো। রুমের দরজাও খোলা ছিলো।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছুদিন কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ গা ঢাকা দিয়েছিলো। তার আগে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে ২৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তার একক সিদ্ধান্তে রীতিনীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবিধান উপেক্ষা করে পরিচালিত হতো স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। তিনি পারিবারিক সম্পত্তির মতো ভোগ করছেন ব্যাংকটির সম্পদ।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কোম্পানি সচিব, মানবসম্পদ বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগের প্রধান পদে বসিয়েছেন তার আত্মীয়স্বজনদের। টানা চেয়ারম্যান পদে তাকে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আকুন্ঠ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। কাজী আকরাম এবং কয়েকজন উদ্যোক্তা যাতে সারা জীবন তাদের পদে থাকতে পারেন, সেজন্য বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন।
১৯৯৯ সালের ১১ মে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২০২০ সালে ব্যাংকটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক হিসেবে সরকারের অনুমোদন পায়। কাজী আকরাম ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকটির পরিচালনায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যানও তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাই দাবি করতেন নিজেকে।
সেই সুবাধে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে কাজী আকরাম নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে। ব্যাংকে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। পর্ষদ সভায় প্রস্তাব তোলা হলেও পরিচালকদের মতামত উপেক্ষা করেই সবকিছু পার করে নিতেন তিনি। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের কাছে বিস্তর অভিযোগ দিয়েছেন ব্যাংকটির কয়েকজন শাখা ব্যবস্থাপক। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজের ব্যবহারের জন্য ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকায় একটি ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো কিনেছেন কাজী আকরাম। ২০১৭ সালে ৩ হাজার ১৬০ সিসির গাড়িটি কেনা হয় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের গ্রাহক নারায়ণগঞ্জের চৈতী গার্মেন্টেসের মালিক আবুল কালামের নামে। ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-৬৯৬৯ নম্বরের গাড়িটি প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা দিয়ে আবুল কালামের কাছ থেকে ভাড়া নেয় ব্যাংক। ভাড়া গাড়ি ব্যবহার করে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হওয়ায় আপত্তি তোলে বাংলাদেশ ব্যাংক গাড়ি কেনার নির্দেশ দেয়।
পরে আবুল কালামের কাছ থেকে গাড়িটি ১ কোটি টাকায় কিনে নেয় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। বাকি প্রায় আড়াই কোটি টাকাও ব্যাংক থেকে দেওয়া হয়েছে এবং সেটা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অগোচরে। ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জারি করা সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে চেয়ারম্যানের জন্য সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকায় একটি গাড়ি কেনা যাবে। চেয়ারম্যানের ব্যবহৃত পুরনো নিশান প্যাট্রল জিপটিও নিজের নামে লিখে নিয়েছেন কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। ব্যাংকের নামে থাকা ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৮৪৭৮ নম্বরের জিপটি ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিআরটিএর মিরপুর অফিস থেকে মালিকানা হস্তান্তর করে নিজের নামে লিখে নেন কাজী আকরাম।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপি হওয়ার পর মেয়ে বেদৌরা আহমেদ সালামের নামে পাঁচ সিটের চট্ট-মেট্রো গ-১১-৬৯১৭ নম্বরের ২৬০০ সিসির টয়েটা প্রিমিও গাড়িটি লিখে দিয়েছেন নামমাত্র মূল্যে। বিধি মোতাবেক ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করার জন্য নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। সর্বোচ্চ দরদাতা তৃতীয়পক্ষ হলেও তার কাছে বিক্রি করার কথা।
১৯৯৯ সালের ১১ মে যাত্রা শুরুর ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী আকরাম। ২০১৮ সালে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের দুজনের পদ বাড়িয়ে চারজন করা হয়। তখন একই পরিবারের চারজন সদস্য পরিচালক নিযুক্ত হতে পারতেন। তাদের মেয়াদও বাড়িয়ে ৯ বছর করা হয়। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে টানা ২৫ বছর চেয়ারম্যানের পদে আছেন কাজী আকরাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের জন্য একটি অফিস কক্ষ, একজন ব্যক্তিগত সহকারী, একজন পিয়ন, অফিসে একটি টেলিফোন, দেশে ব্যবহারের জন্য একটি মোবাইল, একটি গাড়ি থাকার কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা উপেক্ষা করে কাজী আকরাম রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের শেজাদ প্যালেসের তিনতলায় ব্যবহার করেন ৪ হাজার ২০০ স্কয়ার ফুটের একটি অফিস। তার অফিসের নিচেই রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের শাখা।
কাজী আকরাম তার হাত শক্তি শালী করার জন্য তার ছেলে কাজী খুররম আহমেদের শ্বশুর নাজমুল হক চৌধুরীকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করেছেন। তিনি গত ১১ বছর যাবত ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক। ২০১৮ সালে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ব্যাংক কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক পদে একাদিক্রমে দুই মেয়াদে ছয় বছরে বেশি সময় থাকতে পারবেন না। আইনের ব্যত্যয় ঘটলেও প্রভাব খাটিয়ে নিজের বেয়াইকে ১১ বছর ধরে পরিচালক পদে বহাল রেখেছেন কাজী আকরাম।
শুধু তাই নয়, পরিচালকের সর্বোচ্চ বয়স হতে পারে ৭৫ বছর। কিন্তু নাজমুল হক চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৯ জানুয়ারি, সে হিসাবে তার বয়স ৮১ বছর। পরিচালকের প্রাপ্ত সুবিধার বাইরেও বেয়াইকে চট্টগ্রাম থেকে বিমানে ঢাকায় আসা-যাওয়া, পাঁচতারকা হোটেলে থাকা-খাওয়ার খরচও ব্যাংক বহন করত। নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্যই ছেলের শ্বশুরকে স্বতন্ত্র পরিচালক বানিয়েছেন কাজী আকরাম।