অথনৈতিক বার্তা পরিবেশক: মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন দিন আগে অনিয়ম, দুর্নীতি কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম ইন্তেখাব আলমকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার মেয়াদ ছিল ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে এমডি থেকে অপসারণ করে মানবসম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে এমডিসহ দায়ী কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ এ বিষয়ে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমডি পদ থেকে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের এমডিকে অপসারণ করা হয়েছে। তার অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারে ভালোভাবে তদন্ত করা হবে। তাই তাকে মানবসম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়ছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্তের স্বার্থে তাকে এ বিভাগে রাখা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এখন অনেক কঠোর হয়েছে। যারাই অনিয়ম ও দুর্নীতি করবে তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা হবে। দুর্নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন জিরো টলারেন্স। এর আগের একই কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে উত্তরা ফাইন্যান্সের এমডিকেও অপসারণ করা হয়েছিল।’
জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে টানা ১৬ বছর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এসএম ইন্তেখাব আলম দায়িত্ব পালন করছেন। গত দুই বছর টানা লোকসানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। চরম অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৫৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি। মোট খেলাপি ঋণ দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এছাড়া ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে আশঙ্কাজনকভাবে সংস্থান ও মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। সম্পদের গুণগত মান দ্রুত হ্রাস পাওয়ায় পুঞ্জীভূত লোকসানও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। আস্থার সংকটের মধ্যে মিলছে না নতুন আমানতও। এর ফলে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।
সব মিলিয়ে অবস্থা এমন পর্যায়ে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি। আবার আমানতকারীদের এফডিআরের টাকাও সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। আমানতের টাকা ফেরত পেতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছেন গ্রাহকেরা। এছাড়া তহবিল সংকটে নতুন ঋণ বিতরণ বন্ধ হয়ে গেছে।
ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সার্বিক আর্থিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে এমন দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের পর প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যেতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেয়ায় তা আর ফেরত আসছে না। এভাবে চলতে থাকলে নতুন মূলধন জোগানো ছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আর্থিক খাতের যত অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংক পেয়েছে, তার বেশির ভাগের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে জামানতবিহীন কিংবা ভুয়া জামানতের বিপরীতে ঋণ দেয়ার তথ্য মিলেছে। অনেক ক্ষেত্রে জামানত নিলেও তা অতি মূল্যায়ন করা হয়েছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুয়া গ্যারান্টির বিপরীতে ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব কারণে ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। এ তালিকার প্রথম দিকেই আছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশদ পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জানা যায়, গত ১৩ অক্টোবর ফিনিক্স ফাইন্যান্সসহ ছয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে তারল্য সমস্যা, সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থতা, সংস্থান ঘাটতি, ঘাটতি সংস্থান সংরক্ষণের ডেফারেল সুবিধা গ্রহণ, গ্রাহকদের আমানতের টাকা মেয়াদপূর্তিতে ফেরত না দেয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
ফিনিক্স ফাইন্যান্সের বর্তমান আর্থিক অবস্থার জন্য করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রভাবকে দায়ী করে প্রতিষ্ঠানটির এমডি বলেন, দ্বিতীয় দফায় কোভিড ১৯-এর প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন আর্থিক সমস্যায় পতিত হয়। ফিনিক্স ফাইন্যান্সের প্রায় ৪০ শতাংশ ঋণ মামলায় আটকে থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বৈঠকে আরও জানান, ব্যবস্থাপনা পর্ষদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও কিছু ঋণ পুনঃতফসিলের পরিকল্পনা করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির মূলধন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
খেলাপি ঋণ
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাটির মোট বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬০৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বা ২২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর চলতি বছরের মার্চে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬৭ কোটি টাকা বা ৩৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা তখনই উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, যাচাই-বাছাই, ডিউ ডিলিজেন্স এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৪ ধারার নির্দেশনার ব্যত্যয়ে ঘটিয়ে পর্যাপ্ত জামানত দ্বারা আচ্ছাদিতকরণ ব্যতিরেকে ঋণ বিতরণ করা এবং ঋণ আদায়ে তদারকির অভাবের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত মার্চ পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই পর্যবেক্ষণ জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর আরও দুই প্রান্তিকের খেলাপি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৪ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি। আর সর্বশেষ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হিসাবে খেলাপি ঋণ দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। খেলাপি ঋণের হার উঠেছে প্রায় ৫৭ শতাংশ।
মূলধন ঘাটতি
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রভিশন তথা সংস্থান ঘাটতিও বাড়ছে। সংস্থান ঘাটতিপূরণে গত কয়েক বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টানা ডেফারেল সুবিধা নেয়ার ঘাটনাও রয়েছে। তার পরও প্রতি প্রান্তিকে সংস্থান ঘাটতি থাকছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির সংস্থান ঘাটতি ছিল ৮৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের মূলধন উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা থাকলেও গত বছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৯১ কোটি টাকা। বর্তমানে এই ঘাটতি শত কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানের মূলধন পর্যাপ্ততার হার ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ থাকলেও গত বছর শেষে তা হ্রাস পেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমেছে। এক্ষেত্রেও পতনের ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সার্বিক অব্যবস্থাপনার ফলে প্রতিষ্ঠানের সম্পদের গুণগত মান হ্রাস ও ক্রমাগত লোকসান বৃদ্ধির কারণে মূলধন ঘাটতি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাড়ছে লোকসান
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির কর- পরবর্তী নিট মুনাফার পরিমাণ ছিল ২৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা ২০১৯ সাল হতে প্রতিবছর ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির নিট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালে সেই লোকসান এক লাফে বেড়ে হয়েছে ১৩৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। চলতি বছরে নিট লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের ফলে সম্পদের গুণগত মান হ্রাস পাওয়ায় এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যা ক্রমশঃ নেতিবাচক পর্যায়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না : বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সূচকে ক্রমাবনতিসহ ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রমে বিবিধ অনিয়মের কারণে আস্থা সংকটে পড়ে তীব্র তারল্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স। অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, আমানতকারীদের অর্থ মেয়াদপূর্তিতে ফেরত প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে।