নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংক খাতের প্রধান ক্ষত খেলাপি ঋণ। নানা পদক্ষেপ নিয়েও এ ক্ষত নিরাময় করতে পারছে না নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উল্টো দিন দিন বাড়ছে। সবশেষ ২০২৪ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫০ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা, এর মধ্যে তিন মাসেই বেড়েছে ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এক বছর আগে ২০২৩ সালের মার্চে ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ হাজার কোটি টাকা এবং গত ডিসেম্বরে ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার (৬ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণী থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.১১ শতাংশ।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কী পদক্ষেপ নেবে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যারা খেলাপি ঋণের জন্য দায়ী তাদের কথা ও পছন্দমত কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। খেলাপিদের সুবিধা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
দায়ীদের সুরক্ষা দেওয়ায় খেলাপি বাড়ছে মন্তব্য করে টিআইবির এই নির্বাহী পরিচালক জানান, যারা ব্যাংকিং সেক্টর ধসের জন্য দায়ী, এ খাতকে খাদের কিনারায় ফেলেছে, অর্থপাচার ও লুণ্ঠন করছে, তাদের সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে ঋণ খেলাপি বাড়বে। যে অপরাধকে সুরক্ষিত হয়, যে অপরাধকে আরো সুযোগ দেওয়া হয়, সেটা তো বাড়বেই। সেটাই প্রমাণ খেলাপি ঋণ দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত মেনে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চারটি ব্যাংককে চলতি জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক চারটি হলো- সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। তবে মার্চ পর্যন্ত কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এই সীমার মধ্যে আসেনি। কারণ, কোন কৌশলে খেলাপি ঋণ কমানো হবে, সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে সরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েছে।
বাংলাদেশের জন্য দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্তের একটি হলো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কমানো। ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে সংস্থাটি। কিন্তু খেলাপি না কমে উল্টো বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে মার্চ শেষে ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এই ঋণের ২৭ শতাংশ খেলাপি। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ ১২ লাখ ২১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা; যার ৭.২৮ শতাংশ খেলাপি। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ঋণের ১৩.৮৮ খেলাপি, আর বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ৫.২০ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের যে অংক প্রকাশ করেছে এটা প্রকৃত তথ্য না। আমি বরাবরই বলি খেলাপি ঋণ এর চাইতেও বেশি। অর্থ ঋণ আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের মামলাগুলোতে আটকে থাকা খেলাপি ঋণকে জাস্টিফাইড ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। ৬৫ হাজার কোটি টাকা যেটা রাইট অব করা হয়েছে, পাঁচ বছরের পুরোনো মন্দ ঋণ সেটা কিন্তু খেলাপি ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এই দুটোকে যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকার যদি ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে কঠোর না হয় এবং একটা স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় করার ব্যবস্থা না করে, তাহলে এই সমস্যা থেকে আমরা মুক্তি পাব না।