নিজস্ব প্রতিবেদক: পতিত স্বৈর সরকারের দোসর তিনি। আওয়ামী সরকারের দীর্ঘ সময় দেশের আর্থিকখাতকে টার্গেট করে গড়ে তোলেন নিজস্ব সাম্রাজ্য ব্যবসায়ীক গ্রুপ। আওয়ামী প্রভাব বিস্তার করে ঋণের নামে ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। তবে শুধু ব্যাংক থেকেই নিয়েছেন তা নয়। শেয়ারবাজার থেকেও কারসাজি করে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। এই টাকার ভাগ দিয়ে কিনে নেন মন্ত্রীদের আনুগত্য। ফলে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যাংকের টাকায় গড়ে তোলেন বৃত্তবৈভব। অন্তত তিনটি ব্যাংক ফতুর করে এখন তিনি নিরুদ্দেশ। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মাধ্যমে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটলে সরে যায় তার মাথার ছাতা। এর আগে প্রভাব খাটিয়ে খেলাপির বাইরে ছিলেন তিনি। সরকার পতনের পর তারও পতন হয়েছে। নাম লিখিয়েছেন খেলাপির খাতায়। তিনি হলেন দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা।
ব্যাংকখাতে দুর্নীতি আর বেনামি ঋণের মাধ্যমে বহু অর্থ লোপাট হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। বেশ কিছু গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারি অনিয়ম ধরা পড়েছে। এরমধ্যে দেশবন্ধু গ্রুপ অন্যতম। গ্রুপগুলোর মধ্যে অনেকই শুধু ব্যাংক থেকে টাকা লুটে নিয়েছে। কিন্তু দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান শুধু ব্যাংক থেকেই নয়, শেয়ারবাজার থেকেও কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যেখানে রাখা হয়নি পর্যাপ্ত জামানতও। একজন সৎ ও দক্ষ ব্যবসায়ী যখন ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ঋণ পাননি তখন বেনামি প্রতিষ্ঠানের দখলে ছিলো ঋণের বড় অংশ। যার প্রভাব দেশের আর্থিক খাতে বিরাজমান। স্বৈরসরকার পতনের পরপরই আর্থিক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, তারপরও কাটছে না খরা।
আজকের দৈনিক’সহ দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে ‘দেশবন্ধু গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর। এসব খবর রটে যাওয়ায় এখন তিনি ক্ষুদ্ব। ব্যাংকের ডাকে সাড়া দেন না। মিডিয়ার ওপর চরম নাখোশ। উকিল নোটিশ পাঠিয়ে ভয়-ভীতি দেখিয়েছেন আজকের দৈনিক’কে। ব্যাংক খেয়েছেন। এখন আবার মিডিয়ার কাছ থেকে মান-সম্মান গেছে বলে ক্ষতিপূরণ খাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন এক আইনজীবীর মাধ্যমে। ইতিপূর্বে একই কৌশলে আদালতের মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা না দেয়ার জন্য রিট করে রেখেছেন।
দেশবন্ধু গ্রুপের সম্পর্কে নানা অনৈতিক তথ্য হাতে এসেছে। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য সংবলিত রিপোর্টই কেবলমাত্র দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। এতেই তিনি বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোক দিয়ে রিপোর্ট বন্ধ করার বহু চেষ্টা করছেন। ‘টোপে’ কাজ না হওয়ায় ভয় দেখাচ্ছেন মামলার।
জানা যায়, গত ২ অক্টোবর ২০২৩ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের লভ্যাংশের তথ্য প্রকাশ করে দেশবন্ধু পলিমার। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ বা ২৫ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণা করে। লভ্যাংশ ঘোষণা আসার পরদিন প্রতিটি শেয়ারের দাম ৪ টাকা ২০ পয়সা বা ১৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়ে যায়। দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা দেশবন্ধু পলিমারের শেয়ার কারসাজি করে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলো।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেছেন, রিপোর্ট যদি অসত্য হয় তবে তিনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ‘স্টেটমেন্ট’ তুলে ধরে সততার সঙ্গে প্রকাশিত খবরের প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি খেলাপির কারণে ব্যাংকে যাওয়ার পথ ভুলে গেছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে আওয়ামী আমলের আর্থিকখাতের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসবে।
সম্প্রতি ‘আজকের দৈনিকে’র সম্পাদকে পাঠানো এক উকিল নোটিশে যে তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে সেখানেও নিয়েছেন মিথ্যার আশ্রয়। সেখানে দেখা গেছে, তিনি উল্লেখ করেছেন স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক থেকে পাঁচটি কোম্পানীর নামে ১ হাজার ৫৮৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। পরিশোধ করেছে ১ হাজার ১৪৬ কোটি ৩৩ লাখ। সেই হিসেবে তার কাছে ব্যাংকের পাওনা ৪০৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তবে ব্যাংক বলছে, ফান্ডেড আর নন ফান্ডেড মিলে পাবে ৭৭২ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পরিশোধ করেছে ৩ হাজার ৬০৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। তার হিসেবে পাওনা ৩২৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যাংকের হিসেবে পাওয়া প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে ৭৫৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। যার তিনি পরিশোধ করেছে ৩৮০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সেই হিসেবে পাওয়া ৩৭২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর ব্যাংক হিসেবে পাওয়া প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এখানে তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে।
এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার নম্বর ১৬/২০২২ অনুযায়ী গ্রুপটির লোন রিশিডিউল করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যাংককে চিঠি দেয় দেশবন্ধু গ্রুপ। তবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি- এ তিনটি ইসলামী ব্যাংক লোন রিসিডিউল করেনি। বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে ক্লাসিফাইড হিসেবে প্রদর্শন করেছে। সেখানে তিনটি ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত দেশবন্ধু গ্রুপ। ব্যাংকগুলো হলো, বেসরকারি শরীয়াহভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।
জানা গেছে, দেশবন্ধু গ্রুপটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান-দেশবন্ধু সুগার মিলস ২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির সঙ্গে ২০১৯ সাল থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির সঙ্গে এবং ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। দেশবন্ধু গ্রুপের সাতটি কোম্পানির অনুকূলে মোট তিনটি ব্যাংকের বনানী শাখা থেকে ৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি দেশবন্ধু গ্রুপ লোন রিসিডিউলের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন পাঠিয়েছিলো। সাথে আদালতের কিছু কাগজপত্র দিয়েছিলো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি ব্যাংকগুলোর সাথে যোগযোগ করতে বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, লোন রিসিডিউলের ব্যাপারে ব্যাংকগুলো যে পদক্ষেপ নেবে, সেই পদক্ষেপেই বাংলাদেশ ব্যাংক সমর্থন দেবে। পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।
ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠানটি ভালোই চলছিলো। কিন্তু পরে আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার অব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজর না দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে গ্রুপটি।
এই গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সিংহভাগ টাকা দুবাইয়ে পাচার করেছেন। সেখানে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগও করেছেন। এখন দুবাইয়ে আসন গেঁড়েছেন। পাচার টাকায় পাহাড় গড়ে রয়েছেন ধরাঁেছায়ার বাইরে। তাই দেশের প্রতিষ্ঠানের উপর তার কোন মমতা নেই। ব্যাংকের টাকা না দিয়ে তালবাহনা করছে। দেশে তার কিছু পোষ্য রীতিমতো তথ্য-আদান-প্রদান করছে।
জানা যায়, বিনা জামানতে আওয়ামী আমলে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছিলো এই গ্রুপটি। গত ৫ আগস্টের পর থেকেই পলাতক দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান। ব্যাংকের টাকা না দিয়ে এই গ্রুপটি শুধু ঋণের সুদ মওকুফ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি চালিয়েছে। কালক্ষেপণ করে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে।
এব্যাপারে দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বিদেশে থাকায় মোবাইলে পাওয়া যায়নি। তার হোয়াটস অ্যাপে একাধিকার বার ফোন ও ম্যাসেজ দিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাকে ইতিপূর্বে ফোন করে বক্তব্য চাওয়া হলে তার এজেন্টদের দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা চালান।
গতকাল এসআইবিএলের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ নাজমুস সায়াদাত বলেন, ‘একাধিকবার চেষ্টা করেও দেশবন্ধু গ্রুপের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায় করতে পারছিনা। টাকা চাইলে শুধু প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর আর খোঁজ থাকে না। তারা বড় বিপদে রয়েছেন। এই গ্রুপের বিরুদ্ধে এখন কঠোর পদক্ষেপ নিবেন বলেও জানান তিনি।’
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া জানান,‘সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি দেশবন্ধু গ্রুপ থেকে অর্থ আদায়ের। তবে তার অর্থ দেয়ার কোনো প্রকার চেষ্টা দেখছি না। তিনি শুধু কালক্ষেপন করেই যাচ্ছেন।’
দেশবন্ধু গ্রুপের ঋণের অর্থ আদায়ের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না জানতে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে একাধিকবার ফোন করে ও ম্যাসেজ দিয়ে রহস্যজনক কারণে তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, একাধিকবার তাগাদা নিয়ে দেশবন্ধুর কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারছেনা ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের কাছে জামানত না থাকার কারণে অনেকটা হতাশ ব্যাংক বর্তমান পর্ষদ। জোর দিয়েও তেমন কিছু করতে পারছেনা। বর্তমান দশটি দুর্বল ব্যাংকের মধ্যে এই তিন ব্যাংকও রয়েছে। গ্রাহকের টাকা ঠিকমতো না দিতে পারায় চরম দুঃসময়ে কাটাচ্ছে এই ব্যাংকগুলো। গ্রুপটির কাছে এই দুঃসময়ে সহযোগিতা চেয়েও পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্বাহী কর্মকর্তা নামপ্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেনি ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। ব্যাংকটির বিনিয়োগ ও আইন বিভাগের মতামত উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়েছে। নেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত জামানতও। ব্যাংকের কর্মকর্মতার কারসাজির মাধ্যমে ক্ষমতার অব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনা জামানতে ঋণ নিয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডির এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ শতে বলেন, ‘দেশবন্ধু গ্রুপ ঋণের টাকা পরিশোধ না করে, উল্টো বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণের সুদ মওকুফের আবেদন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেইসব আবেদনের কোনো প্রকার সাড়া দেয়নি। তাকে সরাসরি ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো প্রকার অনিয়মের সায় না পেয়ে, রিট করে আদালতের মাধ্যমে ঋণের টাকা না দেয়ার তালবাহনা করে যাচ্ছেন।’